সাহাবী সালমান আল ফারাসি’র ইসলাম গ্রহণের কাহিনি

ইতিহাসের পাতা উল্টালে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই তো মাত্র সেদিন! মানবজাতির কল্যাণে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন মহান আল্লাহ। যাঁর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে অনেকেই পড়ে গিয়েছিলেন বিশাল গোলক ধাঁধাঁ’য়। কেও কেও তাঁকে তুলনা করেছেন চাঁদের সাথে, কেও বা আবার তুলনা করেছেন সূর্যের সাথে। কেও কেও আবার তাঁকেএক পলক দেখেই ইসলামকে ধর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন (আব্দুল্লাহ ইবন সালাম – মদীনা নগরীর ইহুদী রাবাই)। জ্বী পাঠক, কথা বলছি আমাদের মহানবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে নিয়ে।

জনৈক সাহাবী আমির-ইবন আল’আস (Amr ibn al-‘As) যেমন তাঁকে বর্ণনা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে বলেছেন, ‘তিনি এতই অপূর্ব এবং সুদর্শন ছিলেন, যে খালি চেঁয়ে থাকতে মন চায়!‘ যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল – তা জনাব, চেঁয়ে-চেঁয়ে কি দেখলেন? তখন তিঁনি আবার আমতা- আমতা করে বললেন – যত কাছেরই হই! আল্লাহ’র রাসূলের দিকে কি আর ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা যায় সারাদিন? তাঁর ব্যাক্তিত্বের সামনে চোঁখ আপনা-আপনি নিচে নেমে আসে। এই সৌন্দর্য উপযুক্ত ভাবে ফুটিয়ে তোলা আমার পক্ষে সম্ভব না! শুধু জানি তাঁকে দেখলে মনে একটা মিষ্টি প্রশান্তি পেতাম!

তবে মজার ব্যাপার হল, একই প্রশ্ন যখন আনাস ইবনে মালিক (Anas ibn Malik) এবং আরো কিছু তরুন সাহাবীদের করা হয়, তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় নিম্নক্ত বিবরণঃ

নবীজি ছিলেন উজ্জ্বল শ্যামলা। তাঁর মুখমন্ডল ছিল ডিম্বাকৃতি এবং হাত ছিল বেশ কোমল। কোমল হাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে সিল্ক ও ভেলভেট কাপড়কে আনাস ইবনে মালিক ব্যাবহার করেছিলেন উদাহরণ হিসেবে। তাঁর ভাষ্য মতে নবীজীর হাত ছিল সিল্ক ও ভেলভেট কাপড়ের থেকেও কোমল। তিঁনি আরও বলেন, নবীজী খুব বেশি লম্বা যেমন ছিলেন না, তেমনি আবার খাঁটোও ছিলেন না। মাঝারি উচ্চতার ছিঁলেন। নবীজির চোঁখ ছিল বড় বড়, আর দীঘল কালো ছিল চোঁখের মনি। তাঁর চুল ও দাঁড়ি ছিল বেশ ঘন। চুল যেমন একেবারে কোঁকড়ানো ছিল না, তেমনি খুব বেশি সোজাও ছিল না। সাধারণত নবীজি তাঁর চুল কানের লতি পর্যন্ত বড় করতেন এবং প্রতি বছর হজ্ব বা উমরাহ পালনের সময় তা পুরোপুরি চেঁছে ফেলতেন। নবীজির শরীরে তেমন চুল ছিল না, তবে বক্ষের মাঝ বরাবর থেকে নাভি’র আগ-পর্যন্ত চুলের সরু একটি লাইন ছিল। সেই সাথে তাঁর পিঠের ঠিক মাঝখানে ছিল নবুয়াতের মোহর, এবং নবীজীকে সব সময় ঘিরে থাকত সুন্দর মিষ্টি একটি গন্ধ, যা ছিল তাঁর পবিত্র ঘামের গন্ধ ।

নবীজির নবুয়াতের মোহর নিয়ে একটি মজার কাহিনী বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ঘটনার সময়কাল নবীজি নবুয়াত প্রাপ্তির বহু আগের।

এখন যেমন মুসলমানদের সুন্নি, শিয়া সহ বিভিন্ন শ্রেণী আছে; সে সময় খ্রিষ্টানদেরও মূল শ্রেণী ছিল দুইটি – যুইশ খ্রিষ্টান এবং পলিন খ্রিষ্টান।

যুইশ খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে তাদের পরবর্তী নবী স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করতেন ঈসা (আঃ) হলেন আল্লাহ’র নবী, একজন সাধারণ মানুষ, এবং তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মাসিহা। তবে তাঁরা এও বিশ্বাস করতেন যে এখনও তাদের মুসা (আঃ)-এর দেখানো শরিয়াই মেনে চলতে হবে, ঈসা (আঃ)-এরটা নয়। ঈসা (আঃ) যখন এসে বললেন, এখন থেকে এর আগের সকল ওহীকে বিলুপ্ত করা হল, তখন তারা সেটা মেনে নেননি।

অন্যদিকে, পলিন খ্রিষ্টানরা ছিলেন ধর্মযাজক পল-এর উত্তরসরি। যারা বিশ্বাস করতেন ঈসা (আঃ) কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, এবং পৃথিবীতে এসেছিলেন সব ধরণের শরিয়া মুছে দিতে।

শুরু হল যুইশ খ্রিষ্টান এবং পলিন খ্রিষ্টানের মাঝে কথার লড়াই। কে ঠিক, আর কে বে-ঠিক?

এভাবে প্রায় ৩০০ বছর ঝগরা চলার পর, হঠাৎ ঘটল এক মিরাকেল!

রোমান সম্রাট কন্সটেন্টিন (Constantine) ঘোষনা করলেন তিনি খ্রিষ্টান হতে চান!

সম্রাটের ধর্ম বলে কথা।

সম্রাট তাই ঠিক করলেন খ্রিষ্টান ধর্মকে ঢেলে সাজাতে হবে নিজের মনের মত করে। রোমান দেবতাদের আদলে তাই ঈসা (আঃ)-কে বানানো হল সন অব গড (son of God), ২৫শে ডিসেম্বরকে বানানো হল ঈসা (আঃ)-এর জন্মদিন, লেখা হল আধুনিক খ্রিষ্টান ধর্মের চারটি বই, আর জন্ম হল ট্রিনিটি এবং হেলো কন্সেপ্টের। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে ট্রীটি অব নাসেরিয়া-তে (treaty of Nicaea) সম্রাট কন্সটেন্টিন ঘোষনা দিলেন, এখন থেকে তাঁর দেখানো ধর্মই মেনে চলতে হবে খ্রিষ্টানদের। এর বাইরে যারা মত প্রকাশ করবে, তাদের কপালে আছে কঠিন শাস্তি!

ভাগ্যক্রমে কন্সটেন্টিনের মতের সাথে অনেকটা সাদৃশ্য থাকায় পলিন খ্রিষ্টানদের মতাদর্শই তাই কিছুটা কেটে-ছেটে জীবণ পেল আধুনিক খ্রিষ্টানিটি। পরবর্তিতে এই পলিন-ই আবার ভেঙ্গে আবার তৈরি হয় – ক্যাথলিক, প্রটিস্টেন্ট, ইত্যাদি।

কিন্তু কপাল পুড়লো যুইশ খ্রিষ্টানদের! সম্রাটের মতের সাথে মিল না থাকায়, তাদের প্রায় সব বই পুড়িয়ে ফেলা হল পাবলিক লাইব্রেরী থেকে, তাদের বাধ্য করা হল ইরান সহ আরবের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে; অথবা করা হল হত্যা।

এভাবেই কেটে যায় আরো ১৫০ বছর।

জন্মগ্রহণ করেন সালমান আল ফারাসি (Salmān al-Fārisī) ইরানের এক অগ্নী উপাসক পাদ্রির ঘরে।

একদিনের কথা – কাজে যাবার পথে সালমানের সাথে দেখা হয় এক ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ধর্মযাজকের। বেশ কিছুদিন তাঁকে ধ্যান মগ্ন অবস্থায় দেখে, সালমান অনেকটা কৌতুহল বসতই তাঁর ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে জনাতে চায়। ধর্মযাজকের সাথে কথা বলে সালমান দুটি ব্যাপার বুঝতে পারে। ১) ধর্মযাজকটি যুইশ খ্রিষ্টান এবং ২) এত দিন সে যা বিশ্বাস করছিল তা শিরকের নামান্তর। কারণ খোদার কাছে দোয়া প্রার্থনা করার জন্য কোন মিডিয়ামের প্রয়োজন নেই। আগুনকে খোদার সমতুল্য মনে করা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।

সব শুনে তিনি তাই সিদ্ধান্ত নেন যুইশ খ্রিষ্টান হবেন, এবং জেনে নেন কোথায় গেলে এই ধর্মের ব্যাপারে আরো কিছু জনাতে পারবেন।

কিন্তু সব ঘটনা শুনে বাঁধ সাধেন সালমানের বাবা। পাদ্রির ছেলে হয়ে তিনি যুইশ খ্রিষ্টান হবেন ব্যাপারটি তিনি মেনে নিতে পারেননি। সালমানকে তাই ঘরে বন্দি করে রাখা হল, আর ছেলের মাথা নষ্ট করার জন্য হত্যা করা হল সেই যুইশ খ্রিষ্টান ধর্মযাজককে।

এমনই যখন অবস্থা, সালমান আল ফারাসি জীবন নিয়ে পালালেন বাড়ি থেকে, এবং পাড়ি দিলেন রোমানদের দেশে যুইশ খ্রিষ্টান সম্পর্কে আরো কিছু শেখার আশায়।

এর পর কেটে গেছে বহু বসন্ত।

এক গুরুর হাত থেকে অন্য গুরুর হাত করতে করতে সালমান আল ফারাসি’র বয়েস তখন প্রায় ৫০ বছর। এমনই সময় তাঁর জীবনে ঘটল এক চমকপ্রদ ঘটনা।

তাঁর চতুর্থ গুরু মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁকে ডেকে নিয়ে বললেন –

হে সালমান,আমার জানা মতে যুইশ খ্রিষ্টানিটিতে বিশ্বাস করা পূর্ণ-ধর্মযাজক বাকি আছি কেবল আমি। আমার বাকি সব সঙ্গীরা (মতাদর্শে বিশ্বাসীরা) ইতিমধ্যেই গত হয়েছেন। তবে তোমার জন্য একটি সুসংবাদ আছে। আমাদের কিতাবে উল্লেক্ষিত সেই বিশেষ ব্যাক্তি (রাসুলুল্লাহ (সাঃ)) খুব শীঘ্রি আসছে আমাদের মাঝে। তোমার উচিত হবে এখনই তাঁকে খুজে বের করা।

কিভাবে তা সম্ভব জিজ্ঞেস করলে সালমানকে তিনটি দিক নির্দেশক দেনঃ

১. রাসুলুল্লাহ আসবেন এমন দেশ থেকে যেখানে অনেক খেজুর জন্মে।

২. তাঁর পিঠের ঠিক মাঝখানে থাকবে নবুয়াতের মোহর। যা হবে কবুতরের ডিমের মত ডিম্বাকৃতি একটি আচিল। আর তাঁর থেকে বের হয়ে থাকবে ভিন্ন রংয়ের অপূর্ব একটি চুল।

৩. সে উপহার গ্রহন করবে, কিন্তু দয়া বা ভিক্ষা গ্রহণ করবে না।

গুরুর কাছ থেকে উপদেশ পেয়ে সালমান আল ফারাসি তৎক্ষ্নাত রওনা দিলেন রাসুলুল্লাহ’র খোঁজে।

একে-তাঁকে জিজ্ঞেস করে তিনি জানলেন আরবের সব থেকে ভাল খেজুর পাওয়া যায় খাইবারে (বর্তমান ইরাক)।

যেমন কথা তেমন কাজ।

আবারো একে-তাঁকে ধরে তিনি জেনে নিলেন কোন আরব ক্যারাভান খাইবারের দিকে যাচ্ছে।

তিনি ধর্মযাজক মানুষ। হাতে নেই টাকা-কড়ি। তাই অনেকটা পরগাছা হয়েই তাদের সাথে যাবার জন্য মনস্থির করলেন।

কিন্তু বিধিবাম।

আরবরা সে যুগে ছিল আরো অসভ্য। আইয়ামে জাহেলিয়া বলে কথা!

তারা সালমানের অসহায়ত্যের সুযোগ নিয়ে তাঁকে ধরে বিক্রি করে দিল ক্রীতদাস হিসেবে।

ইরাকের বদলে ধর্মযাজক সালমান আল ফারাসি তাই আল্লাহ’র কুদরতে চলে গেলেন মাদিনা!

এরপর কেটে গেছে আরও ২০ বছর। সালমান আল ফারাসি তখন ৭০ এর কাছাকাছি।

একদিন দুপুরে তিনি গাছে উঠে খেজুর পাড়ছেন। এমন সময় তাঁর কানে ভেসে এল তাঁর মালিক কার সাথে যেন আলোচনা করছেন – একজন ব্যাক্তি নাকি নিজেকে আল্লাহ’র রাসূল বলে দাবী করেছেন, আর এখন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন মাদিনাতে!

খবর শুনে সালমান গাছ থেকে এল লাফে নেমে তাঁর মালিকের কাছে ঘটনা কি খুলে জানতে চান। পরিনাম – মালিক তাঁকে গুঁতো দিয়ে আবার পাঠালেন খেজুর আনতে। একজন ক্রীতদাসের এত কিছু জানার কি দরকার?

কিন্তু সালমান- ও নাছোড়বান্দা।

নিজের কাজ শেষ করে তাই তিনি রওনা দিলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে পরীক্ষা করে দেখার জন্য। সাথে নিলেন কিছু খেজুর।

সালমান যখন রাসুলুল্লাহ’র সামনে পৌছলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তখন সাহাবীদের নিয়ে বসে আছেন।

সালমান ইচ্ছে করেই রাসুলুল্লাহ’র দিকে খেজুর এগিয়ে দিয়ে বললেন –

আমার তরফ থেকে এই খেজুরগুলো দান হিসেবে গ্রহন করুন।

তাঁকে অবাক করে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সেই খেজুর খেতে বললেন, কিন্তু নিঁজে খেলেন না।

সালমান তাই আবারো গেল রাসুলুল্লাহ’র সাথে দেখা করতে তার পরদিন।

কিন্তু এবার সে রাসুলুল্লাহকে বলল, আমার তরফ থেকে এই খেজুরগুলো উপহার হিসেবে গ্রহন করুন।

এবার রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের সেই খেজুর খেতে বললেন, এবং নিজেও খেলেন।

ঘটনা দেখে সালমানের বুক ধুকপুক শুরু হল। তাঁর গুরুর তিন নির্দেশনার দুটি মিলে গেছে, বাকি খালি একটা।

কিন্তু সমস্যা হল তৃ্তীয় নির্দেশনা তো রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর কাপড়ের নিচে। সেটা দেখবে কি করে?

পরদিন তাই সে রাসুলুল্লাহ-কে দেখতে গিয়ে তাঁর পেছনে গিয়ে উঁকি-ঝুকি দিতে লাগল।

নবীজি তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিনা-বাক্য ব্যায়ে জামাটি একটু পেছন দিকে ঠেলে দিলেন যেন তাঁর নবুয়াতের মোহর দৃশ্যমান হয়। আর তা দেখার সাথে সাথে সালমান আল ফারাসি লুটিয়ে পড়লেন নবীজির পায়ে আর বারবার চুমু খেতে থাকলেন। আর বিনা-সন্ধেহে ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করলেন!

যাইহোক, মূল বক্তব্য থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে এসেছি। আবার মূল বক্তব্যে প্রবেশ করি।

লেখার এই পর্যায়ে আনাস ইবনে মালিক-এর কিছু ব্যাপার খোলাসা না করলেই নয়।

কেন আনাস ইবনে মালিক ও তরুন সাহাবীরা রাসূল (সাঃ) এর এত নিঁখুত বর্ণনা দিতে পারলেন, কিন্তু বর্ষিয়ান আমির-ইবন আল’আস পারলেন না, এর কারণ ও তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেবে।

ছোটবেলায় যারা বাংলাদেশে কিছু হলেও পড়ালেখা করেছেন, তারা এই উক্তিটির সাথে বেশ পরিচিতঃ নবীজির এক কাজের ছেলে বলেছিলেন – ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর নবীজির সেবা করেছি, কিন্তু তিনি একবারের জন্য হলেও আমাকে বিরক্ত হয়ে ‘উফ’ শব্দটা বলেননি‘। জ্বী পাঠক, আনাস ইবনে মালিক-ই হল সেই ব্যাক্তি। সহজ বাংলায় – নবীজি’র কাজের ছেলে।

আনাস ইবনে মালিক-কে তাঁর মা মাত্র ৭ বছর বয়সে নবীজির দেখ-ভাল করার জন্য কাজের ছেলে হিসেবে দিয়ে যান। সারাদিন সে নবীজির খেদমত করত, এবং রাতে বাড়ি ফিরে যেত মা’য়ের কাছে।

একদিনের ঘটনা। নবীজি তাঁকে কিছু জরুরি কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝ রাস্তায় এসে আনাস ইবনে মালিক দেখলেন তাঁর বন্ধুরা খেলাধুলা করছে। ছোট্ট আনাস তখন সব ভুলে তাদের সাথে খেলতে শুরু করলেন। এদিকে নবীজি দেখেন সময় চলে যায়, কিন্তু আনাস আর আসে না। তিনি বেশ চিন্তিত হয়ে তাই নিজেই বের হয়ে পড়লেন আনাসের খোঁজে। বেশ কিছু দূর গিয়ে নবীজি তাঁকে খুজে পেলেন খেলারত অবস্থায়। নবীজি তখন তাঁকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন হাসতে হাসতে, এবং তাদের সাথে খেলা শুরু করলেন।

যাইহোক, এত কথা মূলত বললাম দুটি বিশেষ কারণে।

এক, গত বছর আমার স্ত্রীর সাথে গিয়েছিলাম এক BBQ-তে। সেখানে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন যে বাড়িতে আংগুর ফেলে এসেছেন। তাঁর ওপর যতগুলো দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, আংগুর আনা ছিল তাঁর অন্যতম। এদিকে বাড়ি থেকে সেই পার্কের দুরত্ব আসা-যাওয়া মিলিয়ে ৮০ মিনিট। নিজের অজান্তেই তাই আমার মুখ দিয়ে ‘এহহে’ টাইপের একটা শব্দ বের হয়ে গেল। স্ত্রীকে দেখলাম অপরাধী হয়ে আমার দিকে কাচুমাচু হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উপলব্ধি করলাম বিরাট বড় এক ভুল করে ফেলেছি। নবীজি যেখানে কাওকে ‘উফফ’ বলেননি বড় বড় অপরাধের জন্য – সেখানে অনিচ্ছাকৃ্ত একটা মামুলি ভুলের জন্য ‘এহহে’ বলা আমার মত পাপি’র সাজে না।

দুই, আমরা প্রায়ই দেখি, মসজিদে মুরুব্বিরা পিচ্চিদের বকাঝকা করছেন দৌড়াদৌড়ি করার জন্য। শুধু যে তারা পিচ্চিদেরই বকা দেন তাই না। সেই সাথে পিচ্চির বাবা’র দিকেও ভয়াল এক ‘লুক’ দেন। বেশ কিছুদিন আগে আমি এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। এক মুরুব্বি ৩-৪ জন পিচ্চিকে বকা দিয়ে তাদের বাবা’র দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন। এমনই সময় আমি মৃদু সুরে পাশ থেকে বললাম,

“জনাব, পিচ্চিরাই তো এমন করবে। ওরা দৌড়াদৌড়ি করবে না, তো কে করবে?”

আমার কথা শুনে পিচ্চিদের বাবা’রা জানে পানি ফিরে পেলেও, ভদ্রলোক হলেন মহা বিরক্ত। ঘ্রীণা ভরা চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।

সহজেই বলে দেয়া যায়, আমাকে মনে মনে ‘ফাজিল, বেয়াদপ’ বলে গালাগালি দিচ্ছেন।

আমি তাঁকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নামাজ পড়া শুরু করাতে রক্ষা। তবে আজ কেন যেন মনে হচ্ছে আমি সেদিন ভুল করিনি।

যাইহোক, এত কথার মূল কথা হচ্ছে, আমরা বুড়োরা অনেক সময় সমাজের নিয়ম-কানুনের কাছে হার মেনে নিজেদের স্বত্তা ও ইচ্ছেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই। লোকে কি বলে, বা লোকে কি ভাবে, সেটাই আমাদের মূখ্য চিন্তা হয়ে ওঠে। বর্ষিয়ান সাহাবী আমির-ইবন আল’আস যেমন সামাজিকতার বেড়াজলে নবীজির দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে পারেননি, কিন্তু তরুনরা কিন্তু ঠিকই এর উল্টোটা করে দেখিয়েছে। এর কারণ, তারা ভয়-ডরহীন। ভয় নেই বলেই তরুন সাহাবীরা রাসূলকে দেখেতে পেরেছিলেন প্রান ভরে। আর আমরা ও ভাগ্যবান তা জানতে পেরে।

আল্লাহ আমাদের তাঁর নবী ও রাসুলের দেখানো পথে চলবার সামর্থ্য দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *