গালে স্কেলের বাড়ি

আমার স্কুল-জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে। যারা এই স্কুলটির সাথে পরিচিত নয় তাদের জন্য বলছি – এই স্কুলটি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতরে, ব্রিটিশ-কাউন্সিলের ঠিক উল্টোপাশে অবস্হিত। হঠাৎ কেন যেন মনে হল আমার এই স্কুলটি নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। আমার স্কুল জীবনের কিছু মজাদার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তাই আজকের এই ধারাবাহিক আয়োজন।

বয়স তখন খুব বেশি না। ক্লাস ওয়ানে পড়ি ।

চোখে চশমা না পড়ায় আমাকে বসতে হয়েছিল ক্লাসের পেছনের সারিতে।

সে সময় ক্লাসের নিয়ম ছিল চশমাওয়ালারা বসবে ক্লাসের সামনের সারিতে আর তুখোড় চোখের অধিকারী ছাত্ররা বসবে ক্লাসের পেছনে।

আপাত দৃষ্টিতে এই নিয়ম সঠিক মনে হলেও এর মাঝে একটা বিশাল কিন্তু লুকায়িত ছিল।

তুখোড় চোখের ছাত্রদের সাথে সাথে ‘মিচকা শয়তান’ টাইপের ছাত্রদেরকেও তখন বসানো হত ক্লাসের পেছনের দিকে।

তুখোড় চোখ তাই দূর থেকে বোর্ড দেখার বদলে পেছনের বেঞ্চের শয়তানিই বেশি দেখত।

আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হল না।

নিয়ম মেনে আমার পেছনে বসানো হলো দুই মহা ত্যাদর ছেলেকে।

যেদিনের কথা বলছি সেদিন চলছিল অংক ক্লাস।

বয়স্ক আধা-পাঁকা সাদা চুলের শিক্ষিকা ক্লাসের সামনের দিকে বসে খাতা দেখছেন। তাকে ঘিরে ছুটাছুটি করছে এক গাদা পিচ্চি।

প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা বলে শিক্ষিকার নাম আজ আমার মনে পড়ছে না। শুধু মনে আছে তিনি ছিলেন খুবই ফর্সা, কপালে ছিল বিশাল এক লাল টিপ, আর সিঁদুর।

যাইহোক, যে মূহুর্তের কথা বলছি, আমি তখন টেবিলে কান লাগিয়ে বসে আছি।

হট্টোগোলের মাঝে টেবিলে কান লাগিয়ে কথা শুনলে মনে হয় তা অনেক দূরের কোন রাজ্য থেকে ভেসে আসছে।

ব্যাপারটা খুবই মজার।

এমনই যখন একটা খুশি খুশি ভাবের মধ্যে আছি, আমার পিছনের দুই মিচকা শয়তান শুরু করল বেঞ্চ নিয়ে টানাটানি, এবং টানাটানির এক পর্যায়ে সেই কাঠের বেঞ্চ “চ্য্য্য্য্য্যাআআআক্কক” টাইপের শব্দ করে মাটি কামড়ে সরে গেল পেছনে।

শব্দ শুনে ক্লাসের সবাই স্তম্ভিত। টিচার বিরক্ত। বেঞ্চটি যেহেতু আমার ঠিক পেছনে, তাই হেলান দেয়ার টেবিল সরে যাওয়ায় আমিও খানিকটা ত্যাক্ত।

এরই মাঝে দেখলাম পেছনের দুই পাঁজি ততক্ষণে ভাল মানুষের লেবাজ ধরেছে। শান্ত ছেলের মত সিটে গিয়ে বসেছে। ভাবসাব এমন যে কিছুই ঘটেনি!

জানি না কি ভাবছিলাম সেই মূহুর্তে! টিচারকে খুশি করতে আমি আবার সেই বেঞ্চকে “চ্য্য্য্য্য্যাআআআক্কক” শব্দ করে টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসলাম।

এরপর কেটে গেছে প্রায় ১মিনিট।

আমি আবার নিজের মত বেঞ্চে এক কান লাগিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করছি।

এমন সময় গালের ওপর চটাশ করে স্কেলের বাড়ি।

আমি হতবিহব্বল।

ক্লাসে মৃদু হাসির গুঞ্জন।

চোখ তুলে দেখি টিচার রাগে গজরাচ্ছেন। খুব সম্ভব বলেছিলেন, “পাজি ছেলে, এখন আবার ভাল সেজেছে।”

মানুষ নির্দোষ হয়েও কোন কোন সময় শাস্তি পায়, ব্যাপারটা সেদিন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন ক্লাসের শেষে আমাকে দেখে আমার নানু চমকে উঠেছিলেন। আমার গালে নাকি স্কেলের দাগ বসে গিয়েছিল। বেশ দূর থেকে সেটা দেখাও যাচ্ছিল।

সেদিন রাতে আমার মা আমাকে পড়াতে বসে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেন। মা’কে সেই প্রথম হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছিলাম।

তখন বুঝিনি কেন কাদলেন। এখন বুঝি। তিনি কেদেছিলেন দুঃখে। নিজে দুই ছেলের বাবা হয়েছি। ছেলেদের গায়ে আচড় লাগলে মনে হয় নিজের গায়ে আচড় লেগেছে। বাইরের কেও আচড় দিলে তো কথাই নেই।

যাইহোক, পরদিন হঠাৎ আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বড় আপা শ্যামলি নাসরিনের রুমে।

গিয়ে দেখি আমার মা আপার সামনে বসে কাঁদছেন। মুখ ওড়না চেপে বসে আছেন।


আমার গালের অবস্থা দেখে শ্যামলি আপাও আঁতকে উঠলেন বলেই মনে হল।


তিনি অংক ম্যাডামকে ডেকে কি বলেছিলেন আমি জানি না।


পরদিন ম্যাডাম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন। এরপর থেকে তাকে আর কারও গায়ে হাত তুলতে দেখিনি।

জানি না তিনি আজও বেঁচে আছেন কিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *