Feature image. two kids walking side by side. Shows their friendship

আমার বন্ধু রাফায়েল

১.

আমার আজকের লেখা আমার এক মহাপ্রাণ বন্ধুকে নিয়ে। জনাবের নাম, ‘রাফায়েল আহসান’। পারিবারিকভাবে সবাই তাঁকে নাওমী নামে চেঁনে। বেশ কিছুদিন আগে বিটিভি-তে মেরিডিয়ান নামের একটি চিপ্সের বিজ্ঞাপণ প্রচারিত হয়। ‘একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও’ টাইপের ডায়ালগ। সেই বিজ্ঞাপণের মূল চরিত্র (ছেলেটি) দেখতে হুবুহুব তাঁর মত। আমি গাঁধা টাইপের হওয়াতে ভেবেছিলাম এটাই বুঝি রাফায়েল। সে আমলে সোশাল মিডিয়া ছিল না। একজন কিছু বললে তাঁকে পা-টেনে নামাবার জন্য দশজন সাথে সাথে ইউটিউবে দাঁড়িয়ে যেত না। গুজবগুলো ডাল পালা ছড়িয়ে, এক-কান, দু-কান করে দাবানলে রুপান্তরিত হত। রাফায়েলের ক্ষেত্রেও তাই হল। সেও আমাদের মাঝে বিখ্যাত হয়ে গেল! প্রথম প্রথম তাই বিখ্যাত মানুষের সাথে কথা বলছি ভেবে আমিও তাঁর সংগ পাবার চেষ্টা করতাম। পরে যখন শুনি এটা সে না – সেই আগ্রহে আমার কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে তত-দিনে সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। রাফায়েলের আমাকে বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। ছেলেকে যতই দূরে ঠেলি – সে তত-ই আমার কাছে আসে। 

যাইহোক, গুরুত্বের বিচারে ‘ছাত্র’ রাফায়েল-কে চেঁনার কোন কারণ নেই। সে ছিল শেষে বেঞ্চের ছাত্র। রোল নাম্বার ও ছিল সবার শেষে। হাতের লেখা ছিল জঘন্য, আর খেলাধুলায় – আরো খারাপ। তবে তাঁর সব থেকে বড় সমস্যা ছিল – কারনে-অকারনে চাঁপা মারা। হয়ত বংগবন্ধু মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে রিক্সা নিয়ে গেছে, এসে সবাইকে বলে বসবে শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে এসেছে! 

লেখার এই পর্যায়ে রাফায়েলের সাথে আমার পারিবারিকভাবে পরিচয়ের ঘটনাটি খুলে বলি।

আমি তখন পড়ি ক্লাস থ্রী-তে। আমার মা জনতা ব্যাংকে কাজ করেন। 

হঠাৎ একদিন শুনলেন তাঁরই আরেক কলিগের মেয়ে আমার সাথে উদয়নে পড়ে। মেয়ের নাম শিলা। 

বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে শুনেছি কাজের থেকে আড্ডা বেশি হয়। আমার মা-ও তাঁর কলিগের সাথে আড্ডা দিতে গেলেন, এবং আড্ডা থেকে যা বেড়িয়ে এল খুব সম্ভবত তা হল নিম্নরূপঃ 

১. শিলা কঠিন পরিশ্রমী ছাত্রী। যা পড়ার নিজে নিজে পড়ে। খুব সুন্দর করে ক্লাসের নো্ট লিখে আনে। একজন আদর্শ সন্তান। ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তবে উজ্জ্বলতা কম হলেও তাঁর মা-য়ের দুঃখ নেই। কারণ তিনি জানেন তাঁর মেয়ে চেষ্টা করছে। চেষ্টাটাই আসল।

২. আমার মা আমার সম্পর্কে এত উদার কিছু বললেন না। সরাসরি বলে দিলেন, আমার ছেলে একটা গাঁধা। সে খালি ফুটানি করে ক্লাসে যায়, আর আসে। কিছু লিখে আনে না। পুরা খাতায় খালি তারিখ আর মানুষের ছবি আঁকা। বাকি সব সাদা।

যাইহোক, আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, আমার মা সেদিন তাঁর কলিগকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর মেয়ের ক্লাস-ওয়ার্কের খাতা আমার সাথে শেয়ার করতে। অন্তত ক্লাসে কি করাচ্ছে সেটা শিলার কাছ থেকে জানতে পারলে, তিনি আমাকে বাড়ী নিয়ে পড়াতে পারবেন নিজের মত করে। 

সেদিন রাতে শিলার কথা যখন আমাকে প্রথম জিজ্ঞেস করা হল – আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি মা-কে লাজুক ভাবে বললাম – আমি শিলাকে চিনি না!

মা বিরক্ত হয়ে বললেন, তা কেন চিনবে? ভাল স্টূডেন্টদের তো চিনবে না। যাও গিয়ে জুনায়েদের গু খাও! (জুনায়েদ আমার মেঝ কাজিন। তুখোড় স্টূডেন্ট। আমার জীবনে আমি ভার্বালি যতবার জুনায়েদের গু খেয়েছি, তত গ্লাস পানি খেয়েছি কি-না সন্ধেহ!)

বেশ কিছুদিন পরের কথা, এক শুক্রবার বিকেলে শিলা, তাঁর ছোট বোন, তাঁর মা, আর তাঁর এক ফুফাতু ভাই আমাদের বাড়ি এসে হাজির। শিলার হাতে এক গাদা ক্লাস নো্টস। আমার কাজ হল সেগুলো সুন্দর করে টুকে ফেলা। 

শিলার ফুফাত ভাইয়ের (রাফায়েল) সাথে কথা বলে জানা গেল, তাঁর ও আমার মতই সমস্যা। ব্যাগ থেকে খাতা বের করে তারিখ লিখতেই সেও দেখে টিচার বোর্ডের সব মুছে ফেলেছে। প্রথম অর্ধেক যখন লেখেনি, শেষের অর্ধেক লিখে আর কি হবে? তাই সেও আমার মত কোন কিছু না লিখেই বাড়ি ফিরে এসেছে। ভাগ্যক্রমে সেও আমার আর শিলার ক্লাসে পরে (কিন্তু ভিন্ন সেকশান)। 

এই ছিল আমার সাথে রাফায়েলের প্রথম সাক্ষাত। 

যাইহোক, অনেক বেশি খারাপ বলে ফেলেছি, এখন রাফায়েলের ভাল কিছু বলি। 

ভালো্র মধ্যে তাঁর খালি ছিল একটা হাসি, আর এক গুচ্ছ পজিটিভিটি। দুনিয়ার তামাম ভয় ও দুঃখকে সে তুঁড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারত। আমার আর তাঁর মিল মূলত এখানেই। দুজনই ছিলাম চরম আলসে, কিন্তু আশাবাদী মানুষ। রাফায়েলের পজিটিভিটি প্রকাশের ঘটনা নিম্নরুপঃ 

ক্লাস থ্রী-তে তখন আমাদের মিডটার্ম পরীক্ষা চলছে। দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন হঠাৎ রাফায়েল এসে হাজির। আমাকে বলল, “৩ ঘন্টা পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না। মাঝখানে খেলাধূলা করতে হবে। এক কাজ করি ১.৫ ঘন্টায় যা পারি লিখব। এরপর খেলাধুলা ১.৫ ঘন্টা। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া। কি বলো?”

আগে পিছে না ভেবেই আমি ও রাজী হয়ে গেলাম। ওয়াদা দিলাম, “হু”।

প্রতিদিন নানু আমাকে স্কুলে আনতে গিয়ে দেখতেন আমি তুমুল আনন্দে রাফায়েলের সাথে ছুটাছুটি করছি।

“রাফায়েলকে পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” =জিজ্ঞেস করলে সে বিশাল এক হাসি দিয়ে আশাবাদী মুখে আমার নানুকে বলত, ‘খুব ভাল’। আমিও তাঁর দেখাদেখি বলতাম, “আমারটাও খুব ভাল হয়েছে”।

কিন্তু সত্যকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যায় না। আমারটাও গেলো না।

পরিনাম – সেমি ফাইনালের সব বিষয়ে আমি আর রাফায়েল, দুজনেই ফেল!

আমার মা খাতা দেখতে গিয়ে কেদে-কেটে অস্থির। তাঁর এতদিনের ধারণা সত্যি হয়ে আজ ধরা দিয়েছে। খুব সম্ভবত আমি বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। রাত জেগে তিনি যা পড়িয়েছেন, প্রশ্ন কমন পরার পরও তার কিছুই না লিখে আমি চলে এসেছি। আমার অর্ধেকে পরীক্ষার খাতা সাদা!   

সে যাত্রায় আমি কিভাবে পাশ করে ফোরে উঠলাম তা আমার কাছে আজো এক চরম বিস্ময়। সম্পুর্ন কৃ্তিত্বই খুব সম্ভব আমার মা,এবং শিলার নো্টসের।

তবে এর থেকে আমি এক মহামূল্যবান শিক্ষা পেয়েছিলাম। পরীক্ষায় পারো, বা না পারো – উত্তর ছেড়ে আসা যাবে না। বানিয়ে বানিয়ে হলেও কিছু লেখতে হবে।

মজার ব্যাপার হল, এর বহুদিন পর, ক্লাস নাইনে আমি একবার বানিয়ে বানিয়ে এক কবিতা লিখে ‘রবী ঠাকুর বলেছেন’ বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম!


ক্লাস থ্রী-র পর রাফায়েলের সাথে আমার কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। স্মৃতি বলতে ক্লাস সিক্সে সরমিতা ম্যাডামের কোচিং। মূলত ক্লাস ফোরে উঠে আমাদের সেকশান আলাদা হয়ে যাওয়াতেই এই বিপর্যয়। তবে ক্লাস সেভেনে উঠেই আমরা আবার এক ঝাকের কৈ।  

ক্লাস সেভেনে আমি দু’বছর ছিলাম। 

প্রথম বছর জন্ডিস হবার কারণে মিডটার্ম এবং ফাইনাল কোনটাই দিতে পারিনি। সেজন্য পরের বছরও আমাকে একই ক্লাসে রেখে দেয়ার সিন্ধান্ত হয়। 

যেহেতু ছোটবেলায় আমাকে এক বছর আগে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল, “এক বছর নষ্ট হলে তেমন কিছু হবে না” –  বলে মুরুব্বিরা আমাকে বুঝালেন। 

যদিও মূল কারণ ছিল ভিন্ন। 

এর আগের বছরও আমি “বিশেষ বিবেচনায়” পাশ করে ক্লাস সেভেনে উঠেছি। 

সব সাবজেক্টে ৭৫+ নম্বর পেয়ে, ৪ নম্বরের জন্য ধর্মে আমি ফেল! 

আমাকে তাই সিক্স থেকে সেভেনে ওঠানোর জন্য আমার মা এবং নানু ঘটি বেঁধে নামলেন।

হেডমিস্ট্রেস শ্যামলী নাসরীনের অফিসে গিয়ে পড়ে থাকলেন দিনের পর দিন ।

কিন্তু শ্যামলী নাসরীন কঠিন হৃদয়ের মানুষ। আমার মা-নানু’র সাথে কথা বলার সময় তাঁর নেই। আমার মা-নানুকে দেখলেই তিঁনি কাজের মাঝে ডুবে যান।    

অবশেষে অনেক চাঁপাচাপির পর যখন তাঁর সময় হল, আমার নানু শেষ চেষ্টা হিসেবে আকুল আবেদন করলেন, “আপা আমার নাতী খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ও মরে যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে। এবারের মত পাশ করিয়ে দেন”। 

নানুর ব্যাকুল আকুতি শুনে শ্যামলী নাসরীন কিছুক্ষণ তাঁর দিকে স্থীর হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘মরে যেতে দিন।‘  

আমার ধারণা, পরপর দুই বছর শ্যামলী নাসরীনের এই জাতীয় কথাবার্তা শোনার জন্য আমাদের পরিবারের কেও প্রস্তুত ছিলেন না। এর থেকে বরং আমি এক বছর বেশী থেকে খেটেখুটে পাশ করি – সেটাই ছিল বাস্তবসম্মত।  

তবে আজ বলতে পারি, তাঁদের সেই ডিসিশানটাই ছিল আমার জীবনের সব থেকে বড় আশীর্বাদ।।      

আমার জীবনকে যদি দুইটি ভাগে ভাগ করতে বলা হয়, একটি জীবন হবে প্রী-ক্লাস সেভেন, আর অন্যটি হবে প্রো ক্লাস সেভেন। 

ক্লাস সেভেনে আমি যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, তারা না থাকলে আমি জীবনটাকে ঠিক মত উপভোগ করতে পারতাম না। 

আমার স্কুল জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ছিল ক্লাস সেভেন ও ক্লাস এইট। 

এই সময়ের বেশ কিছু ঘটনা আমি এর আগেও লিখেছি। আবার এমন অনেক কিছুই এ সময় ঘটেছে যা আমার পেটে বোমা মারলেও কখনও বের করা যাবে না!

যাইহোক, মূল ঘটনায় ফিরে যাই।  

১৯৯৯ সাল। জানুয়ারি মাস।  সকাল ৯ টা।।  

দ্বিতীয় বারের মত ক্লাস সেভেনে পড়ার উদ্দেশ্যে আমি শ্রেনীকক্ষে প্রবেশ করেছি। 

প্রবেশ করার প্রায় সাথেসাথেই দেখি রাফায়েল পেছনের বেঞ্চে বসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

আগেই বলেছি, গুরুত্বের বিচারে “ছাত্র” রাফায়েল মূল্যহীন। আর একজন ফেল করা ছাত্রের কাছে তাঁর মূল্য প্লেগসম। আমি তাই তাঁকে না দেখার ভান করে সামনের সিটে গিয়ে বসলাম।

এর আগে কখনো আমার এক ক্লাসে দু’বার থাকা হয়নি। ক্লাসের অন্যরা ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে তাই নিয়ে আমি মহাচিন্তিত। আমার কান এবং গাল তখন টকটকে লাল হয়ে আছে লজ্জায়। চারপাশে আমি পিটপিট করে তাকাচ্ছি। পূর্বের পরিচিত আর কে-কে ফেল করে এই ক্লাসে আছে বোঝার চেষ্টা করছি। 

এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম আমার পেছনে এসে বসেছে অতি বিরক্তিকর দু’টি ছেলে । এদের আমি আগে কখনও দেখিনি। খুব সম্ভবত নীচের ক্লাসের কেও। কারনে-অকারণে তাঁরা হাসাহাসি করছে, এবং যেই পাশ দিয়ে যাচ্ছে, হাই-হ্যালো বলছে।

আমি মনে মনে আল্লাহ’র কাছে দোয়া করলাম, হে আল্লাহ, ‘এই দুই বান্দরকে আমার থেকে দূরে রাখো। এরা যেন আমার সাথে কথা না বলে’। কিন্তু পোড়া কপাল! ঠিক তখনই তাদের মাঝে একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, “এই তুই কে-রে”?    

প্রথমে আমি শুনেও না শুনার ভান করে সামনে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু সেই ছেলে নাছড়বান্দা। এ কথা ও কথা বলে আমাকে বিরক্ত করতে লাগল। বাধ্য হয়েই আমিও কথা বলা শুরু করলাম। কথা বলে জানা গেল এদের একজনের নাম মারজান, আর আরেক জনের নাম সাক্ষর। মারজান ছেলেটা দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু সাক্ষরটার কোথায় যেন গলদ আছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলেই পেটাতে ইচ্ছা করে। সাক্ষর সেই টাইপের অন্তর্গত। যাইহোক, তাদের সাথে আমার কি কথা হয়েছিল আমার মনে নেই, তবে ভাল কিছু যে না সেটা অনুমেয়। কথা শুরু হবার ১০ মিনিটের মাথায়, আমাকে রাফায়েল পেছন থেকে ধরে আছে, আর সাক্ষর পেট ধরে মাটিতে বসে কাতরাচ্ছে।  আমি সাক্ষরের তলপেটে ঘুষি বসিয়ে দিয়েছি!

ঘুষির এই ঘটনার পর, ক্লাসের ছেলেরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। 

এক দল আমাকে সমীহের চোখে দেখতে লাগল। অন্যদল – সন্ত্রাস হিসেবে। 

এই  ‘অন্য দলের’ হাত থেকে আমাকে আগলে রাখার “গুরু-দ্বায়িত্বটা” রাফায়েল স্বউদ্দোগেই নিজের হাতে তুলে নিল। 

আমাকে মারতে হলে আগে ওকে মারতে হবে – এই জাতীয় একটি ডায়লগও দিয়ে দিল। 

তাঁর এই ডায়ালগ শুনে অন্যরা যতটুকু ভয় পেল, আমি ভয় পেলাম তার দশ গুন। কারণ ওকে মেরে, আমাকে মারা ‘অন্যদের’ পক্ষে তেমন কোন কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছিল না।  

আজকে আমরা যে ঢাউশ শরীরের রাফায়েলকে চিনি, ক্লাসে সেভেনে সে ছিল এর ৫ ভাগের ১ ভাগ।

 এতই হ্যাংলা-পাতলা ছিল যে আমিই ওকে একবার ৪ ফুট উপরে তুলে আছাড় দিয়েছিলাম।

ঘটনা নিম্নরুপঃ

ক্লাস সেভেনে আমি ততদিনে নিজের একটা অবস্থান গড়ে নিয়েছি (মন্দের মধ্যে ভাল ছাত্র হিসেবে)। 

নতুন উদ্দ্যমে পড়ালেখা শুরু করেছি। 

মিডটার্ম পরীক্ষায় আমাদের ক্লাসের যে গুটি কয়েকজন সব বিষয়ে পাশ করেছে – আমি তাদের অন্যতম!

এমনই এক দিন, লাঞ্চ করে ক্লাসে ফিরছি। হঠাৎ পেছন থেকে রাফায়েলের আক্রমণ! সেই আক্রমণও যেন-তেন আক্রমণ না। খামচা-খামচি, কিল-ঘুষি লেভেলের আক্রমণ! 

কিন্তু রাফায়েলের কপাল খারাপ। 

আমি ততদিনে মনে-প্রাণে ঠিক করে ফেলেছি বড় হয়ে বাংলাদেশ আর্মিতে যোগ দেব। প্রতিদিন আমি ৩৫ টা বুকডন দেই, ঘন্টায় একটি করে কলা খাই, বিকেলে ৩ কিলোমিটার দৌড়াই, আর এ-এক্স-এন চ্যানেলে উনিভার্সেল সোলজার্স দেখে মারপিট প্রেকটিস করি।   


কোন কিছু চিন্তা না করেই তাই ওকে ধরে দিলাম এক আছাড়।

পরিণাম – মাটিতে পড়তে পড়তে রাফায়েলের করুণ আর্তনাদ, ‘মেয়েরা দেখতেছে! মেয়েরা দেখতেছে!’, আর সেই সাথে পাশ থেকে ভেসে এল খিলখিল হাসির আওয়াজ। 

ঘটনা কি বুঝতে পারলাম ক্লাসে ফেরত যাবার পথে। রাফায়েল তখন আমার কাঁধে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আছাড় খেয়ে সে মারাত্বকভাবে জখম। যতটা না শারীরিক ভাবে, তার থেকেও বেশি মানসিক ভাবে। মূল ঘটনা নিম্নরুপঃ  

দুপুরে লাঞ্চের ঘন্টা পড়তেই রাফায়েল ক্লাস থেকে ছুটে বের হয়ে যায়। নীচে মামার দোকানে সিংগারা আর কোক খাবে। খাওয়া দাওয়া শেষে সবে মাত্র ক্লাসের দিকে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় সামনে এসে হাজির নারী-মহলের কিছু রুপসী। তারাই রাফায়েলকে “হ্যালো” বলে ডাক দেয়, এবং এ-কথা, ও-কথার মাঝে রাফায়েলের ক্ষুদ্রাকার গঠন নিয়ে তামাশা করে। তাঁদের মিথ্যাচার শুনে রাফায়েলের মাথায় আগুন ধরে যায়। তাদের ভূল প্রমাণ করার জন্য রাফায়েল ঠিক করে আশেপাশের কোন অবলা পুরুষকে পিটিয়ে নিজের শক্তি প্রদর্শন করবে।

আল্লাহ’র লীলাখেলা। পাশে তাকিয়ে দেখে – আমি হেঁটে  যাচ্ছি। 

সেকালে এখনকার মত সবার হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। তাই সে আমাকে না জানিয়েই ডাইরেক্ট একশানে গিয়েছিল। পরিণতি – আমার শার্টের একটি বুতাম ছেড়া, আর রাফায়েলের ইজ্জত অন দ্যা লাইন।  

তবে এই ঘটনার কারণে কেও যদি রাফায়েলকে হিংস্র মনে করেন, তবে বিরাট ভুল করবেন। সত্যি বলতে, ছেলেরা এমন-ই। বন্ধুদের সাথে মারপিট, ঝগড়া, আর খুনসুটি তাদের নিত্যদিনের ব্যাপার। এগুলো না করলে তাদের ভাত হজম হয় না।  প্রমাণ স্বরুপ আমার নিজের একটি ঘটনা শেয়ার করছিঃ

সে সময় সপ্তাহের একটি দিন ছিল আমাদের খেলার ক্লাস। প্রথম ২০ মিনিট ছিল পিটি। আর পরের ২০ মিনিট নিজেদের মত ছুটাছুটি। আমাদের খেলার স্যার সে সময় ছিলেন মিঃ ওয়াহাব। তাঁকে সবাই আড়ালে আদর করে “লেন্দু” বলে ডাকত। তিঁনি প্রথম ২০ মিনিট অতি বিরক্তির সাথে আমাদের পিটি করাতেন, এবং বাকী ২০ মিনিট সুফিয়া আপার সাথে গল্প করতেন। যে দিনের কথা বলছি, পিটি-র সময় রাফায়েল ছিল আমার সামনে। হঠাৎ আমার মনে হল, ওর পাঁছায় একটা লাথি দিতে পারলে মজা হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। সুযোগ বুঝে  ওর পাঁছা বরাবর দিলাম এক লাথি। কিন্তু রাফায়েলও টেটন। কিভাবে যেন আগেই বুঝে গেছে আমি লাথি মারব। পা উঠানোর সাথে সাথে সে দুই লাফে আরও সামনে সরে গেল। আমার পা তাই ওর পাঁছা মিস করে উঠে গেল বেশি উপরে। পরিণাম – “স্য্য্যিয়াততত”  শব্দ করে ছিঁড়ে গেল আমার প্যান্টের তলা!

বি দ্রঃ সেদিন এই রাফায়েলই আবার আমাকে গার্ড দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল ক্লাসের শেষে। পেছন দিকে আমি ব্যাগ ধরে ছিলাম, আর সে সামনে দিয়ে আস্তে-আস্তে হাঁটছিল যেন কিছু দেখা না যায়।

যাইহোক, রাফায়েল-কে নিয়ে এই ঘটনাগুলো শোনার পর কোন পাঠক যদি মনে করে থাকেন, আমি আজ লিখতে বসেছি রাফায়েলকে পঁচানোর উদ্দেশ্যে, তবে আপনি ৫০% ভুল।  আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য তা নয় (পুরোপুরি ভাবে)। মূল কারণটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।।

আমি তখন নীচের ক্লাসের এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি (সেই মেয়ের অন্য একজনের সাথে বিয়ে হওয়াতে নাম উল্ল্যেখ করছি না।)।

মেয়ে আমার থেকে দুই হাত লম্বা।

সেকালে প্রেম বিষয়টি ছিল অতি মাত্রায় গোপন।  

প্রেম বলতে আমরা তখন বুঝি  বিপাশা হায়াতের চোখ লাল করা, ‘আমার মনের কথা কি আপনি বুঝতে পারেন না” – টাইপের ডায়ালগ।  

সোশাল মিডিয়া না থাকায়, লোক-দেখানোর তাড়নাও  খুব একটা ছিল না।

সে কারণেই হোক, কিংবা নিজের কাপুরুষতার জন্য – জীবনে তাই কখনও সেই মেয়েকে ‘ভালবাসি’ বলা হয়ে ওঠেনি । তবে লেখার এই পর্যায়ে সেই মায়াবতীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটা না বললেই নয়। ঘটনা নিম্নরূপঃ

আমি তখন পড়ি ক্লাস টু-তে ।

কোন এক বর্ষাস্নাত সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলা তাঁর ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন আমাদের বাসায়। তাঁরা বসেছেন আমাদের বৈঠকখানায়। 

আমাকে যখন ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করতে ডাকা হল, আমি তখন ঘরে বসে পড়ছি। 

বৈঠকখানায় গিয়ে প্রথমেই আমি ভদ্র মহিলাকে একটি লম্বা সালাম দিলাম। ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে আমাকে পাশে এসে বসতে বললেন।

তাঁর এক পাশে আমি, অন্য পাশে নিজের ছেলে।

ছেলের্টি হ্যাংলা-পাতলা গড়নের। মাথার চুল প্রায় চ্যাঁছা এবং মারাত্বক ফর্সা। অনেকটা জাপানিজ টাইপের দেখতে। 

ছেলেটির গায়ে গাড় নীল রংয়ের জিন্সের শার্ট এবংপ্যান্ট। 

এর আগে আমি কোন ছেলেকে এভাবে মিলিয়ে শার্ট-প্যান্ট পড়তে দেখিনি। নতুনত্ব দেখতে আমার ছোটবেলা থেকেই ভাল লাগে। আমি তাই এই বিচিত্র কাপড় দেখে অভিভূত হলাম! 

যাইহোক, আমাকে যখন ছেলেটির সাথে পরিচয় করানো হল, আমি তাঁকে প্রায় সাথে সাথেই আপন করে নিলাম। 

এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে বললাম, ‘এসো খেলতে যাই’।      

আমার এই আতীথিয়তা এবং ভদ্রতা দেখে ভদ্রমহিলা খুব সম্ভবত অভিভূত হয়ে গেলেন। আমার মাকে বললেন, “আপনার ছেলেতো বেশ মিশুক! কি সুন্দর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল!”

বৈঠকখানা থেকে বের হতে হতে গোপনে শোনা নিজের সেই প্রশংসায় আমার বুক গর্বে ভরে গেল। আমি মিটিমিটি হেসে তাই সেই ছেলেকে নিয়ে গেলাম আমার খেলার ঘরে। সেখানে তখন থরে-থরে সাজানো অন্তু’র কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খেলনা (পাঠক আমার কানাডা আসার গল্প লেখাটি পড়ে থাকলে বুঝতে পারবেন)।

যাইহোক, ছেলেটাকে নিয়ে খেলতে বসে আমি তাঁর মাঝে কিছু অপরিপক্কতা লক্ষ্য হলাম।

প্রথমত, এই ছেলে  আর্মি-আর্মি খেলার কিছুই জানে না।

আমার আর্মি সোলজারস-গুলো আমি বারবার দাঁড়  করিয়ে দেই, আর একটু পর ঘুরে দেখি এই ছেলে তাদের লাইন ধরিয়ে শুইয়ে দিয়েছে। গায়ের ওপর আবার বিছানার চাঁদরও টানা।

দ্বিতীয়ত, ভাব-সাব দেখে সে তেমন আনন্দ পাচ্ছে বলেও মনে হল না। হাঁটুতে থুতনি লাগিয়ে বসে আছে। 

এভাবে তাই খেলা বেশি দূর এগুলো না। 

আমি ধরেই নিলাম এই ছেলের মাথা খারাপ। 

আমি তাই বুদ্ধি করে তাঁকে দিয়ে আসলাম আমার ছোট খালার ঘরে।

এর মা যেহেতু আমাকে মিশুক বলেছেন – এখনই এ-কে বসার ঘরে ফেরত পাঠানো যাবে না! তার থেকেও বড় কথা, এই ছেলে এখন ফেরত গেলে আমাকে পড়তে বসতে হবে। আমি তাই তাঁকে খালার ঘরে রেখে, পা টিপে এসে বসে গেলাম নিজের মত করে খেলতে। 

সেদিন রাতের কথা। রাত তখন ১১ টা বাজে।

আমি বিছানায় মশারির নিচে শুয়ে আছি। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, কিন্তু গায়ে বাতাস লাগছে না। 

হঠাৎ শুনি আমার মা ছোট খালাকে বলছেন, ‘আপার মেয়েটা কি শান্ত না?’ 

আলোচনা শুনে আমি খানিকটা ধাক্কা খেলাম। মেয়ে মানে! 

ছেলে ভাবে সারা সন্ধ্যা কি তাহলে একটা মেয়ের সাথে খেললাম! 

আমি কাঁপাকাঁপা গলায় তাদের জিজ্ঞেস করলাম – ‘ও ছেলে ছিল না’? 

প্রশ্ন শুনে মা-খালা হেঁসে কুটিকুটি।   

আর আমি?

বুকের মাঝে আমি তখন এক হাহাকার অনুভব করলাম। 

যাবার আগে ছেলেটি আমাকে গুডবাই দেয়ার সময় বলে গেছে, সেও আমার সাথে একই স্কুলে পড়ে, আর আগামীকাল সে আমাকে খুঁজে বের করবে।  

সেকালে ছেলেরা মেয়েদের সাথে খেলছে – ব্যাপারটা ছিল লজ্জাজনক।

‘ছেলেরা খেলবে ছেলেদের সাথে। মেয়েরা খেলবে মেয়েদের সাথে’ – এমন একটা বুঝ সমাজ আমাদের রন্ধ্রে সে বয়সেই ঢুকিয়ে দিয়েছে।   

আমাকে একটি মেয়ে সবার সামনে ‘হাই’ বলছে, ব্যাপারটা চিন্তা করতেই তাই আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। 

ঘুমের মাঝেও সেদিন হয়ত কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম! আমার তা মনে নেই। 

যাইহোক, এই আলোচনা খুব সংক্ষেপে শেষ করছি – পরদিন স্কুল শেষে হঠাৎ আমি পেছন থেকে স্কুল ব্যাগে টান অনুভব করলাম। 

লাজুক একটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসছে। পরণে সাদা শার্ট আর নীল ফ্রক।  

হ্যাংলা-পাতলা, মারাত্বক ফর্সা, অনেকটা জাপানিজ টাইপের দেখতে। মনে মনে ভাবলাম, “মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে?!”

আমি প্রেমে পড়ে গেলাম।

এরপর কেটে গেছে বহু বসন্ত। তাঁর সাথে আর তেমন কথা হয়নি। 

দূর থেকেই তাঁকে দেখতাম। ভাল লাগত।

এভাবেই দূর থেকে একদিন লক্ষ্য করলাম সে আমার থেকে দিন দিন লম্বা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হিল পড়েছে।  তাকিয়ে দেখি ভুল – হিল পড়েনি। 

এই নিয়ে যখন আমি মহা চিন্তিত, এবং প্রায়ই বাসার বারান্দায় গ্রীল ধরে ঝুলাঝুলি করে লম্বা হবার চেষ্টা করছি, একদিন আবিস্কার করলাম, সেই মেয়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। 

এত বছরের গোপন প্রেমের এমন মৃত্যু!  চোঁখ ফেটে কান্না এল। আমি ভেঙ্গে পড়লাম। ক্লাসে ছুটে এসে হেড-ডাউন করে বসে রইলাম, এবং হঠাৎ অনুভব করলাম কেও আমার পিঠে হাত রেখেছে। 

মুখ তুলে তাকাতেই দেখি – সেই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড। 

‘আজ লাঞ্চে কথা আছে। ২ তালায় এসো। একা আসবে’ – বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন।

ঘটনার এই আকস্মিকতায় ‘আমি একটুও চমকাইনি’ – বললে ভুল হবে।  কারণ রাফায়েল আমার চেহারা দেখে সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিল, কিছু একটা হয়েছে।    

উল্লেখ্য, আমি আর রাফায়েল তখন একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসি। ঘটনার সময় সে ক্লাসে উপস্থিত ছিল না।  ফিরে এসে দেখে আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। 

আমাকে শক্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে রাফায়েল বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকল – কি হয়েছে। 

তাঁর চাঁপাচাঁপিতে এক সময় তাই তাঁকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে হলো। একবার না, চার-পাঁচ বার। 

প্রতিবার ঘটনার বলার পরই সে আরেকজনকে ডেকে আনে। আমাকে আবার শুরু থেকে ঘটনা বলতে হয়। 

এভাবে চার পাঁচ বার একই ঘটনা বলার পর আমার থেকে রাফায়েলকেই তখন বেশী উত্তেজিত মনে হল।

আমাকে সেই মেয়ের প্রেমিক পিটাতে চায় – এমন একটা গুজবও সে চারদিকে ছড়িয়ে দিল। 

ঘটনা সবার মনে এতটাই দাগ কাটল যে ক্লাসে যারা মারামারি পারে না – নিরীহ টাইপ – তারা এসে আমাকে সমবেদনা জানাতে লাগল। আর যারা কাজের থেকে কথা বেশি  বলতে পছন্দ করে, তাঁরা এক জোট হয়ে ঠিক করল, সেই মেয়ের বয়ফ্রেন্ড আমার গাঁয়ে হাত তুললে তাঁরাও ছেড়ে কথা বলবে না। 

আমাকে বলা হল, আমাদের মিটিংয়ের সময় তাঁরা লাঠি-সোঠা হাতে আশেপাশে থাকবে। প্রতি ১ মিনিট পরপর তাদের একজন সেই ক্লাসের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করবে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। ডু নট ওয়ারি।


তাঁদের ভরসায় আমি তাই সেদিন লাঞ্চে মিটিং করতে গেলাম জনৈক বয়ফ্রেন্ডের সাথে। 

মিটিংয়ের এক মিনিটের মাথায় দেখা গেল রাফায়েল সেই ঘরের সামনে ঘুরঘুর করছে। বুঝতে পারলাম রাফায়েল ছাড়া কেও আমাকে গার্ড দিতে আসেনি। সর্দারকে ফেলে শীর্ষরা ভেগেছে। 

এদিকে মিটিংয়ে গিয়ে দেখি তিঁনি (বয়ফ্রেন্ড) আমাকে একা আসতে বললেও, নিজে একা আসেননি। ৪-৫ জনকে সংগে নিয়ে এসেছেন। ঘটনার এ পর্যায়ে আমি যখন মার খাব বলে নিশ্চিত, তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে কাপা গলায় বললেন,  “ তুমি আমাদের দেখেছ, এটা কাওকে বলো না, প্লিজ! ওর ফ্যামিলি জানলে অনেক বকাঝঁকা করবে ও-কে।”

সেই ছেলের সাথে এরপর আমার কি কথা হয়েছিল তা আমার মনে নেই। তবে কোন বিচিত্র কারণে এই মিটিংয়ের পর থেকে তাঁর প্রতি আমার কোন রাগ বা অনুযোগ ছিল না। তার থেকেও বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, মিটিং রুম থেকে বের হয়ে আসার সাথে সাথেই সেই মেয়ের প্রতি গভীর আবেগটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। হয়ত মনের গভীরে আমি তাঁকে কখনও নিজের করে পেতে চাইনি। শুধু দূর থেকে দেখাতেই ছিল  ভাল লাগা! 

আমার ধারণা, মাঝে মাঝে মানুষ কি চায়, তা সে নিজেও জানে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পাওয়ার আশা আছে বলেই  আমরা একটি অবাস্তব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে পছন্দ করি। যখন সেই আশার বুকে ধাক্কা লাগে, তখন সেই স্বপ্নকেই আবার নিছক ছেলেমানুষি বলে মনে করি। একটি মেয়ে আমার থেকে দুই হাত লম্বা। স্বাভাবিকভাবেই  আমার উচিত ছিল নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। কিন্তু কোন বিচিত্র কারণে আমি আমার মনকে সেটা বোঝাতে পারিনি সেদিনের আগে।  এর থেকে অবশ্য একটা শিক্ষা আমরা নিতে পারি – Life can be full of hurt in short-term. But it is wonderful in a long-run. Allah never burdens you with pain you cannot bear. He certainly has a master plan for you. You just have to wait and be patience. 

যাইহোক, মূল বিষয় থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। মূল বিষয়ে আবার ফেরত যাচ্ছি। 

যদি কেও বলে বিপদে বন্ধুর আসল পরিচয়, আমার ধারণা রাফায়েল তাতে ১০০ তে ১০০ পাবার যোগ্য। যখনই আমি কোন সমস্যায় পড়েছি, রাফায়েল নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করেছে। যদিও আমি নিজের ব্যাপারে তেমনটা কখনোই দাবী করতে পারব না। কারণ, এই ঘটনার কিছুদিন পরই আমি রাফায়েলকে ছেড়ে হান্নানের সাথে বসার সিদ্ধান্ত নেই। 

সেই ঘটনা না হয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাকুক। 

তবে আশা করি পাঠক আমার এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য এখন কিছুটা হলেও টের পেয়ে গেছেন। 

লেখার মূল উদ্দেশ্য হল প্রকাশ্যে রাফায়েলের কাছে ক্ষমা চাওয়া। I was never the friend that he deserves. 


৩.

রাফায়েলকে কেন আমি আমার অন্যতম ভাল বন্ধু মনে করি, ব্যাপারটা এখন খুলে বলি।  

ঘটনার শুরু ১৯৯৪ সালে। 

আমি তখন পড়ি ক্লাস ফোরে । 

আমার উঠা-বসা সাদী নামের এক ছেলের সাথে। অত্যন্ত অমায়ীক ও মিশুক প্রকৃ্তির ছেলে। 

ক্লাস টু থেকে আমরা একই বেঞ্চে বসি। 

সে আমলে, সাদী ছিল হিন্দী মুভির বিশেষ পোঁকা। সারারাত সে বাসায় হিন্দী মুভি দেখত, আর সকালে এসে আমাদের হিন্দী মুভির কাহিনী আর গান শোনাত।  হাম্মা হাম্মা, বা মুস্তাফা মুস্তাফা গান গুলো আমি তাঁর কাছেই প্রথম শুনি।  

যাইহোক, ছাত্র হিসেবে সাদী ছিল রাফায়েলের মতই খারাপ। ব্যাতিক্রম শুধু ছিল, খারাপ ছাত্র হওয়াতে রাফায়েলস  সব সময় চেষ্টা করত ক্লাসের পেছনে বসার। কিন্তু সাদী বসতে ভালোবাসতো ক্লাসের সামনে।  সাধারণত খারাপ ছাত্ররা ক্লাসের পেছনে বসার চেষ্টা করে কারণ এতে টিচারদের চোঁখে পরার সম্ভাবনা থাকে কম। তবে সাদী সে সবের ধার ধারত না। সে ছিল বীর। ক্লাসে সবার সামনে বসে সে ড্যাব-ড্যাব করে টিচারদের দিকে তাঁকিয়ে থাকত। আর পড়া জিজ্ঞেস করলে না বলতে পারার কারণে কাঁন ধরে দাঁড়িয়ে থাকত।  এজন্য অবশ্য তাঁকে সাহসি বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে বন্ধুদের সাথে বাঁজি লেগে মেয়েদের বাথ্রূমে ঢুকে পড়া টাইপের কাজ দুঃসাহস না অন্য কিছু – সেটা পাঠকদের বিবেচনার জন্য তোলা থাকল।  

যাইহোক, যখনকার কথা বলছি, সবেমাত্র আমাদের লাঞ্চ টাইমে ক্লাসের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে । লাঞ্চ টাইমে তখন আর কোন টিচার আমাদের গার্ডে দেন না। নিজেদের আমরা তাই বেশ বড় বড় ভাবতে শুরু করেছি। 

এরই মাঝে কোন এক তুচ্ছ কারণে আমার সাথে সাদীর লাগল ঝগড়া। 

কি কারনে ঝগড়া, তা আমার মনে নেই। 

শুধু মনে আছে সাদী আমাকে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জিজ্ঞাস করছে, “তুই কেন আমার সাথে কথা বলবি না? বল বলবি। নাইলে জাইতে দিব না।”

সাদী ছিল আমার থেকে দুই হাত লম্বা।

আমি তাই চেষ্টা করলাম তার হাঁতের নীচ দিয়ে বেরিয়ে যেতে।

আর বিপর্যয়ের শুরু সেখানেই।  

আমি তাঁর হাত গলে বের হয়ে যাবার জন্য হাঁটু ভেঙ্গে নীচু হলাম। কিন্তু আমার দেখাদেখি সাদীও কিছুটা নীচু হয়েছে সেটা আমি লক্ষ্য করিনি। হাঁটু সোজা করে দাঁড়াতেই আমার মাথা গিয়ে লাগল তাই সাদীর থুতনীতে। নড়ে উঠল সাদী, ছিটকে গেল চশমা, আর মাটিতে পড়েই তা চূর্ণ-বিচূর্ন! 

সে আমলে চশমা সব কাঁচ দিয়ে বানানো থাকত। খোদায় কৃপায় একবার মাটিতে পড়লে আর রক্ষা নেই! 

আমি আর সাদী বেশ কিছুক্ষণ ভাঙ্গা চশমার দিকে তাঁকিয়ে রইলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জনেই হতবিহব্বল।

সে মূহুর্তে সাদীর কি মনে হয়েছিল, আমি জানি না। তবে আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব থেকে বড়-অন্যায়টা আমি করে ফেলেছি। এর থেকে খারাপ দিন এই জীবনে আমার আর আসবে না!

সে আমলে চশমা কেনা ছিল আমাদের কাছে এক বিরাট ব্যাপার।

দোকানে গিয়ে সেটা বানাতে প্রায় দু’সপ্তাহ লাগত।

সাদীকে তাই সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি ছুটে চলে আসলাম ক্লাসে।        

যাইহোক, ব্যাপারটা সেখানে শেষ হলেও পারত। কিন্তু কপালে দূর্ভোগ থাকলে যা হয় – 

ক্লাসে এসে আমি থরথর করে কাঁপছি। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করছি সাদী যেন হাওয়ায় মিশে যায়।

এমন সময় দেখি সাদী হন্তদন্ত হয়ে আসছে। 

এসে প্রথম কথা, ‘তুই আমার চশমা ভেংগেছিস! তুই এখন কিনে দিবি’

সাদীর কথা শুনে আমি আবাক। আমি কিভাবে কিনে দেব? আমি টাকা পাবো কোথায়!

আমি তাই সাদীকে ‘পারব না’ বলেই দিলাম দৌড়।

কেন যেন মনে হচ্ছিল, এর থেকে যতটা দূরে থাকা যায় সেটাই আমার জন্য ভালো। 

টিফিন টাইম তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমার বুকে তখন ও চিনচিনে ব্যাথা করছে চিন্তায়। এমন সময় দেখি সাদী কাইফুল ওয়ারা নামের এক ছেলেকে নিয়ে আমার দিকে আসছে। কাইফুল ছিল সদ্য স্কাঊট। সদ্য স্কাঊটরা নিজেদের পুলিশ বলে জ্ঞাণ করে। হঠাৎ হাতে পাওয়া ক্ষুদ্র ক্ষমতার তাপে এরা প্রায়ই অন্ধ হয়ে থাকে। কাইফুল-ও তার ব্যাতিক্রম নয়। তার পরামর্শে সাদী তাই আমাকে ধরে নিয়ে গেল অফিস রুমে। কিন্তু সাদির কপাল খারাপ। অফিসের কর্মচারীরা সাদীর চশমা ভেংগেছে শুনে রাগের বদলে যেন একটু খুশি-ই হলেন। তাদের মাঝে একজন সাদী’কে বাঁদর ডাকলেন, অন্যজন বললেন, “মামলা  ‘ডিসমিস'” ।

কিন্তু সাদী’র মাথায় ততক্ষণে ব্যাপারটা ঢুকে গেছে। 

অফিস তাঁর মামলা না নেয়ায়, সে কাইফুলের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল আমাকে ধরে ওয়াহাব স্যারের কাছে নিয়ে যাবে। স্যারকে কাইফুল হাত কঁচলাতে কঁচলাতে কি বলেছিল তা আমার জানা নেই। আমি তখন রুমের বাইরে সাদীর সাথে অপেক্ষা করছিলাম। তবে স্যার আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই নিয়ে গেলেন প্রিন্সিপাল শ্যামলি নাসরিন আপার ঘরে। কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। কোন বিচিত্র কারণে সাদীকে অফিসের সবাই বাঁদর সাবস্ত করল। পরিণাম –  আমাদের দুই জনকেই দেয়া হল ওয়ার্নিং লেটার। আমাকে সাদির চশমা ভাঙ্গার জন্য, আর সাদীকে – নিজের চশমা ভাঙ্গার জন্য!    

এর পর থেকে সাদী’র সাথে আমার কিছুটা দূরত্ব তৈরী হয়। চশমা ভাঙ্গার কারণে এর পর থেকে সাদী’র পরিবার আমাকে খুব একটা ভালো চোখে আর দেখতেন না।

ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো খুঁনসুটিতে   মা-বাবা’র জড়িয়ে পড়া যেহেতু আমাদের দেশের প্রাচীন রীতি – আমাকেও তাই বিশেষভাবে মানা করে দেয়া হলো যেন সাদীর সাথে আর কোন দিন কথা না বলি।   

এরপর চলে গেছে বহু বসন্ত।

১৯৯৮ সাল। ক্লাস সেভেন।

সাদী, আমি, রাফায়েল – তিনজনই  বিভিন্ন সময় ফেল করে একই ক্লাসে এসে জুঁটেছি। 

ক্লাসে সেভেনে তখন আমাদের বিশাল দল। ১০-১২ জন একসাথে ঘুরে বেড়াই। রাফায়েল, সাদী-ও সেই দলে জুঁটেছে। মাস্তান-মাস্তান ভাব।

টিফিনের  ঘন্টা  পড়লেই আমরা তখন রাশু আপার আফিসের সামনের দেয়ালে পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিংগারা-কোক খাই। আড্ডা মারি। মেয়ে দেখি।

এরই মাঝে হঠাৎ একদিন ঠিক হল সাদী-র জন্মদিন এবার ঘটা করে পালিত হবে। পার্টি হবে সাদীদের বাড়ীতে।  আর দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে  – আমাকেও দাওয়াত দেয়া হল সেই পার্টিতে। 

সাদী’র বাড়ি দাওয়াত শুনেই আমার মা সাথে সাথে ‘না’ করে দিলেন। 

প্রায় ৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণে – “আমি নির্লজ্জ , কিন্তু এত নির্লজ্জ তা তিনি জানতেন না “– এই জাতীয় কিছু কথাও আমাকে শুনতে হল। 

কিন্তু সে সময় আমার চোখে রঙ্গিন চশমা।

আমি পার্টিতে না গেলে বন্ধুরা কি মনে করবে – সেটাই আমার মূল মাথা ব্যাথা!

আমি তাই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলাম এবং এক সময় আবেগঘন পরিবেশে পার্টি করতে যাবার অনুমতি মা-নানু’র কাছ থেকে ম্যানেজ করলাম।

সেদিন কত তারিখ ছিল আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে এক বর্ষাস্নাত দুপুরে, শাহারুখ খানের পোষ্টার, আর গানের সিডি হাতে আমি হাজির হয়েছিলাম সাদীদের বাড়ি। 

পার্টি হল। খাওয়া হলো। সবাই মিলে শাহারুখ খানের ‘বাদশা’ মুভি দেখালাম।

কিন্তু আসল ঘটনার শুরু তার পরদিন।

সেদিন কোচিং থেকে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ আমার নানু’র প্রশ্ন, “ফাহিম তুমরা কি সাদী’র বাড়িতে সিগারেট খাইছ?”।

প্রশ্নটা শুনে আমি কিছুটা বিচলিত হলাম।

ঘটনা আংশিক সত্য।

আমি খাইনি, কিন্তু বেশ কয়েকজন সেদিন বারান্দায় সিগারেট খেয়েছিল বলে আমি জানতাম। সে কারণে সাদী’ রুমের চারপাশে এয়ার ফ্রেস্নার ও দিয়েছিল।

কিন্তু নানু জানলো কিভাবে? 

অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করা হলে সব থেকে ভাল ডিফেন্স হল, প্রশ্নকর্তাকে “কেন” জিজ্ঞেস করা। ইন্টারোগেশান যিনি করছেন তিনি কত দূর জানেন সেটা আগে জানা দরকার। এর পর অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা।  

আমিও তাই করলাম, এবং নানু’র বক্তব্য থেকে যা জানা গেল তা নিম্নরুপ – 

আমি তখন কোচিংয়ে। আমার নানু অন্যান্য অভিভাবকের সাথে বসে বুট চিবুচ্ছেন। এমন সময় জনৈক বন্ধুর আম্মা এসে সবার সামনে নানুকে বলেছেন, “আপনার নাতি তো আমার বাড়ি এসে সিগারেট খেয়েছে। আমার কাজের মেয়ে বারান্দার সামনের উঠানে সিগারেটের বাট পেয়েছে।”

আল্লাহ’র কুদরত। 

এমন সময় নাকি পাশ দিয়ে যাচ্ছিল রাফায়েল। সেদিন পার্টিতে সে যেতে পারেনি পারিবারিক কারনে। 

তাঁকে ডেকে উপস্থিত সবাই ঘটনার সত্যতা জানতে চেলে সে নাকি বলেছে, “আর যেই খায় খাইতে পারে, কিন্তু ফাহিম খায় নাই ফর শিওর!।”

বহুদিন আগে এই ছোট ঘটনাটা ফেইসবুক শেয়ার করে লিখেছিলাম – “অনেকদিন পর কথাটা মনে পরায় রাফায়েলকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, “ইয়েস দোস্ত ইউ ওয়ার রাইট। থাংক ইউ ফর ডিফেন্ডিং মি দেট ডে।” সেই রাফায়েল আজকে অনেক বড় ডাইরেক্টার। বড় বড় শিল্পীদের নিয়ে নাটক মুভি বানাচ্ছে। খোদার কাছে দোয়া করি সে আরও বড় হোক। তাকে নিয়ে আগামী পর্বে অবশ্যই কিছু লিখবো।“ 

আজ আমি সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করলাম।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *