ব্যাগওয়ালী’র কাহিনী

আমার স্কুল-জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে। যারা এই স্কুলটির সাথে পরিচিত নয় তাদের জন্য বলছি – এই স্কুলটি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতরে, ব্রিটিশ-কাউন্সিলের ঠিক উল্টোপাশে অবস্হিত। হঠাৎ কেন যেন মনে হল আমার এই স্কুলটি নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। আমার স্কুল জীবনের কিছু মজাদার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তাই আজকের এই ধারাবাহিক আয়োজন।

যখনকার কথা বলছি, উদয়নের নতুন বিল্ডিং তখনও চালু হয়নি। তবে ‘হবে হবে’ করছে।

প্রতিদিনই আমরা উদয়নে যাই চরম উত্তেজনা নিয়ে। যে কোন মূহুর্তে আমাদের বলা হবে, “ঘটি-বাটি গুছাও, তোমাদের এখনই নতুন বিল্ডিংয়ে যেতে হবে!”

এই যখন পরিস্থিতি, আমাকে ক্লাস করতে পাঠানো হলো পুরানো উদয়নের আধা-পাকা ইটের বিল্ডিংয়ের দো’তলায়।

খুব সম্ভবত আমার শিক্ষিকা ছিলেন কাউসার আপা।

অত্যন্ত সুন্দরী এই ভদ্রমহিলা দেখতে ছিলেন সুমনা হকের মত।

আমি যখন তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতাম, তিনি প্রথমেই আমার কাছে এসে হাটু গিড়ে বসতেন। এরপর চোখ বন্ধ করে, আমার কানের কাছে এসে কথা শোনার চেষ্টা করতেন।

তিনি আমার মুখের এত কাছাকাছি চলে এসেছেন বলে আমি আরো আস্তে কথা বলা শুরু করতাম। দিন শেষে এই কারণে আমার নানুর সাথে দেখা হলেই তিনি বলতেন, “আপনার নাতী কিচ্ছু গুছায় বলতে পারে না! আমি প্রতিদিন জিজ্ঞাস করি – তোমার কোন হেল্প লাগবে, বাবু? উত্তরে সে খালি ‘ম’ ‘ম’ করে।”

এই কারণেই হোক বা অন্য কোন অজানা কারণে, আমাকে এনে বসানো হলো ক্লাসের একেবারে সামনে।

প্রথম সিটে বসে আমি তখন সারাদিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি অথবা পেছনের তাকিয়ে আমার বন্ধুরা কি করছে তা দেখার চেষ্টা করি।

আমার এই অনবরত সামনে-পেছনে তাঁকিয়ে থাকার দৃশ্য দেখে কাউসার আপা আরও খেপে গেলেন। আমার নানুকে মোটামোটি প্রতিদিনই তিনি বলতে লাগলেন, “আপনার নাতী খুবই অমনোযোগী, দুষ্টু।”

এই যখন অবস্থা, হঠাৎ একদিন আমার মনে প্রেমের ভাব উদিত হলো কেজি-১ এ থাকতেই!

ঘটনা নিম্নরুপঃ

কেজি-১ এ আমি তখন বসে আছি ক্লাসের সামনের বেঞ্চে।

হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক মেয়েকে কোলে নিয়ে ক্লাসে এসে ঢুকেছেন।

আশেপাশে তাকিয়ে তিনি দেখলেন মেয়েদের পাশে বসার কোন সিট খালি নেই।

শুধু সামনের বেঞ্চে গাধা টাইপের ছেলের পাশে কিছু জায়গা খালি।

অনিচ্ছাসত্তেও তিনি তাই মেয়েকে আমার পাশে রেখে মাঝখানে একটা বিশাল এক ব্যাগ বসিয়ে দিলেন, এবং যাবার আগে মেয়ে চুমুটুমু দিয়ে কানে কানে কি এক মন্ত্র দিয়ে গেলেন।

ভদ্রলোক চলে যাবার পর মেয়েটি চোখ ছলছল করে উঠল। মনে হলো সে বেশ মর্মাহত।

আমি তাই তাকে শান্তনা দেবার জন্যেমুচকি হেঁসে বললাম, “কেঁদো না। আমরা এখন থেকে বন্ধু।”

সেই থেকে শুরু নতুন এক বন্ধুত্বের।।

এরপর চলে গেছে বেশ কিছু দিন।

শত চেষ্টা করেও আমি আর সেই ব্যাগ আমাদের মাঝখান থেকে সরাতে পারিনি।

বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বেশ কয়বার অনুরোধ করেছিলাম বৈ-কি। তবে তাতেও তেমন একট্যাঁ কাজ হয়নমেয়ের এক কথা – “বাবা বলেছে ব্যাগ না সরাতে। ব্যাগ সরালে ছেলেরা গায়ে গা লাগাবে।”

এরই মাঝে আমরা আবার টেলিফোন নাম্বার অদল-বদল করেছি।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দুই-তিন ঘন্টা আমরা ফোনে কথা বলি।

‘কি রংয়ের জামা পড়ে আছো, কি রংয়ের চুলের ফিতা’ – এই জাতীয় খাজুরে আলাপ।

কিন্তু তাতেও বাঁধ সাধলেন তাঁর বাবা। ভদ্রলোক একদিন চার ঘন্টা স্ত্রীকে ফোন দিয়ে না পেয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করলেন। পরিণাম – আমার সাথে সেই মেয়ের ফোনে কথা বলা বন্ধ!

এই ক্ষণিকের কথা বলতে না পারার কারণেই হয়ত – আমি মেয়েটাকে মনে মনে ভালবেসে ফেললাম।

এই ভালোবাসা আরও গাঢ় হল যখন এক বর্ষাস্নাত দিনে দেরী করে ক্লাসে গিয়ে দেখি সেই মেয়ের পাশে বসে আছে ঠোঁট কাটা আলমগীর! (ছেলে আলমারি থেকে খেলনা নামাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলে। ৮ টি সেলাই দিতে হয়। রক্তাক্ত ব্যাপার)।

যাইহোক, সেদিন পেছনে বসে আমি তাই দেখতে লাগলাম তাঁরা কি করছে।

তাদের হাসাহাসি দেখে হিংসেয় আমি অন্ধ!

আর এর মাঝেই লক্ষ্য করলাম – তাদের মাঝখানে ব্যাগটা নেই!

এই নিয়ে রাগ করে আমি তাই সেই মেয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম।

সে ডানে হাটে তো আমি বামে।

পরদিন থেকে ক্লাসে আগে আসলেও আমি পেছনে বসতে শুরু করলাম। আবার পেছন থেকে বোর্ড দেখা যায় না বলে ক্লাসের সামনে হাটু গিড়ে বসে বোর্ডের লেখাও টুকা শুরু করলাম।

কিন্তু আমার এই উদ্ভট আচরণ দেখে কাউসার আপা ধরে নিলেন আমি দুষ্টুমি করার জন্যই হয়ত পিছনে গিয়ে বসেছি। আমি হয়ে গেলাম ব্যাক লিস্টেস!

এরপর কেটে গেছে আরো কিছু দিন।

সেই মেয়ের সাথে আমার আর আগের মত কথা হতো না।

একদিনের কথা, কোন এক কারনে আমাদের ক্লাস নিচে নিয়ে আসা হল আরেক সেকশানের বাচ্চাদের সাথে।

নীনা আপা ক্লাস করাচ্ছিলেন।

ক্লাসটি বিশাল হলেও দুই ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রী এক সাথে থাকায় সেখানে বসার যথেষ্ঠ সিট ছিল না।

আমি তাই দেয়ালে সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সবার সাথে গান করছি (A, B , C, D…)।

হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি সেই মেয়ে আরেক ছেলের সাথে মাখামাখি হয়ে বসে আছে মাঝখানে ব্যাগ নেই!

লাঞ্চের সময় তাই ঠিক করলাম মেয়েটাকে কঠিন কিছু কথা বলা দরকার। তাঁকে তাই ডেকে একটু দূরে নিয়ে বললাম – “এসব ছেলেদের সাথে এত মিশো না।”

মেয়ে অবাক হয়ে বলল – কেন মিশলে কি হবে?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম – তোমাকে বিয়ে করতে চাবে।

মেয়েটি হাসতে হাসতে ঘুরে চলে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

পরদিন সকালে ক্লাসে ঢুকে দেখি সেই মেয়ে ঠোট কাটা আলমগীরকে তাঁর পাশে বসতে দেয়নি। আমার জন্য জায়গা রেখে দিয়েছে। আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বেঞ্চে চাপড় দিয়ে বলল – “আস, এখানে বস”।

আমাদের মাঝে ব্যাগটা সেদিন ছিল না ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *