২০০২ সালের কথা। SSC’র টেস্ট পরীক্ষা চলছে। পরদিন খুব সম্ভব ব্যাবসায় পরিচিতি পরীক্ষা। বসার ঘরের সোফাতে পা উঠিয়ে বসে বসে রিভিসান দিচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার ছোট খালা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
ঘটনা কি জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হল না। নিজে থেকেই চেঁচিয়ে বললেন – “ফাহিম!!! তোমাদের কানাডা যাবার ভিসা এসে গেছে!!”
অতি দুঃখের খবরের মত, অতি আনন্দের খবরেও মানুষ কিছুক্ষণের জন্য জমে যায়। আমিও জমে পাথর হয়ে বসে রইলাম। জীবণের হঠাৎ ছুঁড়ে দেয়া ভালো ব্যাপারগুলোকে সহজে আমরা মেনে নিতে পারি না। জীবন যুদ্ধে কয়লা হয়ে গেছে যে মন, রঙ্গিনকেও সে সাদাকালোই দেখে। কথাটা কেন বললাম একটু খুলে বলি।
ঘটনার শুরু ১৯৯০ সালে। আমি আর আমার খালাতো বড় ভাই ‘অন্তু’ তখন হাপ-প্যান্ট পড়ে দুনিয়া কাপাই। দুজনেই পড়ি উদয়ন বিদ্যালয়ে। একজন কেজি ১-এ আর একজন কেজি-২ তে। প্রতিদিন সকালে স্কুল গিয়ে আমাদের দেখা হয়। দূর থেকেই আমরা চোখাচোখি খেলি। স্কুল শেষে নানু আমাদের আমড়া আর চিপ্স কিনে দিতেন। সেটা খেতে খেতে আমরা বাড়ি ফিরতাম। এর পর শুরু হত খেলাধুলা সন্ধ্যা পর্যন্ত । রাতে বড় খালা এসে অন্তুকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলত সেই মহাযজ্ঞ।
দিন এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। আমার দুনিয়া ছিল স্কুল থেকে বাসা, বাসা থেকে স্কুল আর অন্তুর সাথে খেলাধুলার মাঝে সীমাবন্ধ।
এরই মাঝে আমার নানা রিটায়ার করলেন। আমরা আজিমপুরের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম গ্রীনরোড। এবং অনুভব করলাম, অন্তু আস্তে আস্তে একটু দূরে সরে যাচ্ছে। আজকাল সে আমাদের বাড়ি আগের মত পড়ে থাকে না। নানু বাড়ি আসলেও দেখি আমার সাথে খেলার বদলে বসে বসে কি-সব লেখালেখি করে। খেলতে আসো বললে সবাই বলে – “অন্তু এখন ক্লাস ১-এ উঠেছে। ওকে ডিস্টার্ব করো না। ও পরে খেলবে“। আমি মন খারাপ করে একা একা খেলি। খোদার কাছে দোয়া করি অন্তুর পড়া যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। আমরা তাহলে আবার এক সাথে খেলতে পারব।
ছোট মানুষের দোয়া বলেই কি-না কে জানে? আমার সমস্যার সমাধান হল সাথে সাথেই! অন্তুকে দেখা যেতে লাগল সবখানে। সারাক্ষণ সে খেলনা হাতে বসে আছে। অবাক করার ব্যাপার, এখন উল্টো আমাকে জোড় করে পড়াশুনা করানো হচ্ছে, আর অন্তু ঘুরছে নিজের মত!
এই রহস্যের কুলকিনারা করতে তাই ধরা দিলাম ছোট খালার কাছে। তিনি তখন সবে ক্লাস ৯ বা ১০-এ পড়েন। তিনি কাওকে না বলার শর্তসাপেক্ষে আমাকে যা বললেন, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। অন্তুরা নাকি সারা জীবণের জন্য চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া!
ব্যাপারটা অন্তুর কাছে জানতে চেলে, প্রথমে সে ‘না-না’ বলে; তবে পরে চাঁপের মুখে ‘হ্যা-হ্যা’ বলতে বাধ্য হয়। আর এর কিছুদিন পরই আমাকে অস্ট্রেলিয়া চলে আসতে বলে, প্লেনে করে সে রওনা দেয় অস্ট্রেলিয়া। উপহার স্বরুপ আমাকে দিয়ে যায় তার খেলনা আর এক গাঁদা ছবি। অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে, নিজের হাতে আঁকা ছবিগুলো সে আমাকে ২৫ পয়সায় বিক্রি করত হাত খরচের জন্য। ছবিগুলো মূলত ছিল ডাবের। কোন বিচিত্র কারণে সেই সময় এই ডাবের ছবির প্রতি আমার প্রচণ্ড মোহ কাজ করত।
যাইহোক, অন্তুকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসার পর থেকেই আমার মনে এক সুপ্ত ইচ্ছা ছিল বিদেশে যাবার। রাতে ছাদের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম আমি বরফের মাঝে গড়াগড়ি করছি। আমার পাশে অন্তু।
২.
আমার বিদেশ যাবার শখ প্রথম পূরণ হয় ১৯৯৭ সালে।
ইতিমধ্যে আমার মা-বাবা অস্ট্রেলিয়া যাবার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত মানুষেরই দুটি করে জন্মদিন থাকে। একটি বার্থ সার্টিফিকেটের, আর অন্যটি SSC সার্টিফিকেটের। ভুলক্রমে আমার মা’য়ের দুটো জন্মদিনই আমরা ব্যাবহার করেছিলাম এক এপ্লিকেশনে। পরিনাম – অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন থেকে আমাদের পাঠান হয়েছিল বিশাল এক চিঠি । যার সারমর্ম – “আমাদের আর অস্ট্রেলিয়া আসার কোন আশা নেই । কারণ এক মানুষের দুই জন্মদিন থাকা অসম্ভব! তাদের ধারণা, আমরা মিথ্যা বলছি! “ শত চেষ্টা করেও তাদের বোঝানো গেল না এটাই এই দেশের রীতি। আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরও জন্মদিন তিনটি!
যাইহোক,আমাদের এপ্লিকেশান বাতিলের এই খবরে আমার মা-বাবা, আর ছোট খালা যতটা হতাশ হলেন, আমি হতাশ হলাম তার চেয়েও দশ গুন। আমি ইতিমধ্যেই আমার স্কুল আর পাড়ার বন্ধুদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে নিয়েছি। এলাকার সবাই জানে ফাহিমের বিদেশ যাওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। খেলার মাঠে তাই তারা আমাকে ক্যাপ্টেন বানাতে শুরু করেছে। আমি চলে যাচ্ছি। কবে না কবে আবার খেলবে আমার সাথে, সেই চিন্তা থেকেই এই পদক্ষেপ। তবে সময়ের সাথে সাথে এক সময় তারাও হতাশ হতে থাকে, এবং এক সময় সেই হতাশা পরিণত হয় চাঁপা ক্ষোভে।
প্রায়ই তারা জিজ্ঞেস করতে থাকে – কবে যাবেন?
আমিও বলতে থাকলাম – এই আর কিছু দিন বাদে!
আর এভাবেই দিন-রাতের ফেরে পড়ে চোঁখের পলকেই পার হয়ে গেল ২-৩ টি বছর।
মান-ইজ্জতের এমনই যখন টানাপোড়ন, তখনই আবার জীবনে এল নতুন এক সুসংবাদ। আমার বাবা কাজের থেকে পোস্টিং পেয়েছেন দুবাই।
পূর্বে না হোক, পশ্চিমে তো যাচ্ছি! আমার সাথে সাথে বন্ধুমহলেও খুশির জোয়াড় বয়ে গেল।
সবাই বসে তখন আমরা গল্প করি দুবাই কেমন হবে, তা নিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ইজ আউট অব দ্যা পিকচার। আমাদের কথোপকথনের উদাহরণ নিম্নরূপঃ
বন্ধুঃ ফাহিম ভাই, দুবাইয়ে ঠান্ডা কেমন?
আমিঃ খুবই ঠান্ডা। বরফ পড়ে সারাদিন।
বন্ধুঃ ওইখানে কাক আছে?
আমিঃ প্রশ্নই আসে না। বিদেশে তো ময়লা নেই। কাক থাকবে কেন? কাক খাবে কি?
এই ভাবেই চলল আরো কিছুদিন। এক সময় বাবা ও চলে গেলেন দুবাই। আর আমরা গ্রীনরোডের বাড়ি ছেড়ে বাসাবো।
যাইহোক, মূল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। আবার ফিরে যাই মূল বক্তব্যে।
১৯৯৭ সাল। জুলাই মাস। তীব্র তাপদাহ।
বরফে গড়াগড়ি করার স্বপ্ন নিয়ে আমি উঠে বসেছি বিমান বাংলাদেশের বিজি০০৭ ফ্লাইটে। গন্তব্য – দুবাই।
প্লেনের ভেতরে উত্তেজনায় আমি থরথর করে কাঁপছি। ঢাকা থেকে দুবাইয়ের যাত্রাপথ মাত্র ৪ ঘন্টা হলেও, সেকালে ১ ঘন্টার যাত্রাবিরতি নেবার প্রচলন ছিল ভারতে ।
এক যাত্রাপথে দুইবার উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা পাব এই আনন্দেই আমি তখন আত্মহারা! যা দেখছি তাই ভাল লাগছে। যা খেতে দিচ্ছে তাই অমৃত মনে হচ্ছে! সে এক অন্যরকম অনুভুতি। খুশিতে মাথা ব্যাথা করা টাইপের অনুভুতি!
যাইহোক, এভাবেই প্রায় ছয় ঘন্টা পর দুবাইয়ের মাটিতে আমাদের প্লেনের চাকা স্পর্ষ করল। সে সময় এখনকার মত বিল্ডিংয়ের সাথে লাগোয়া করিডর ধরে মানুষ প্লেনে ওঠা নামা করত না। উঠা নামা করতে হত প্লেনের সাথে লাগানো বিশাল এক সিড়ি দিয়ে। আমার সামনে যখন প্লেনের দরজাটা পটাশ শব্দে খুলে গেল , আমার বরফ নিয়ে খেলার স্বপ্নও খেল এক বিরাট ধাক্কা। হীম শিতল বাতাসের বদলে আমার মুখে ঝাপ্টা খেলো দজখের আগুনসম বাতাস। বুঝতে আর বাকী রইল না, খোদা আমার বাবা-কে এমন এক দেশে পাঠিয়েছেন, যেখানের আবহাওয়া বাংলাদেশের থেকেও গরম।
৩.
যখনকার কথা বলছি, দুবাই তখন নতুন ভাবে গড়ে উঠছে। নতুন শেখ হিসেবে আল-মাকতুম সাহেব গদিতে বসেছেন, এবং বসেই দুবাইকে নতুন ভাবে গড়ে তোলবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই ইঙ্গিতও যা তা ইঙ্গিত নয়! আরব সাগর কেটে মেইন-লেন্ডে খাল বানাবার মত ভয়ংকর ইঙ্গিত (এখন যা পাল্ম আইল্যান্ড নামে পরিচিত)! সেজন্যে মরুভূমিতে খোড়াখুড়িও শুরু হয়ে গেছে।
যাইহোক, বিমানবন্দর থেকে বাড়ি যেতে যেতে আমি যেসব ব্যাপারে অভিভূত হলাম, তা নিম্নরূপঃ
১. দেশটা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারপাশ আলো ঝকঝকে। রাস্তার দুই পাশ বড় বড় গাছ দিয়ে ভরা! দেখে মনে হয় রাস্তার মাঝেও ছোট ছোট পার্ক বানিয়ে রাখা হয়েছে।
২. আব্বুর কাছ থেকে জানলাম, সেখানে কখনো বিদ্যুৎ যায় না!
৩. এখানে সবার বাসাতেই রুমে-রুমে এয়ারকন্ডিশান আছে।
৪. এখানে হাত তুলে দাঁড়ালে টেক্সি সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই টেক্সিতে আবার মিটার লাগানো। ভাড়া নির্ভর করবে কত দূর যাব তার ওপর।
৫. মানুষ রাস্তা পারাপারের সময় গাড়িগুলো এখানে আপনা-আপনাই থেমে যায়!
৬. এখানে কোকের অনেক ঝাঁঝ, আর দাম মাত্র এক টাকা! সেই কোক আবার পাওয়া যায় রাস্তার চিঁপাচাঁপিতে বিশাল এক ফ্রিজের মধ্যে (ভেন্ডিং মেশিন)! সেই ফ্রিজে এক টাকা ফেললেই, নীচ দিয়ে কোক বের হয়ে আসে!
৭. বাঙ্গালিরা এই দেশে এসেও মানুষ হয়নি। দূর্নীতি চারপাশে!
শেষের ব্যাপারটা কেন বললাম সেটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
শুরুতেই বলেছিলাম আমার বাবা কাজের থেকে পোস্টিং পেয়ে দুবাই যান অফিসার হিসেবে। সে সময় ব্যাংকের অফিসারদের ফুল-ফার্নিসড বাসা দেয়া হত। বিশাল বাড়ির সাথে তারা পেতেন – খাওয়ার টেবিল, সোফা সেট, খাট, আর একটা বড় আলমারি।
কিন্তু বিপত্তি বাঁধল এই বাজেটের টাকা নিয়ে।
জনৈক ভদ্রলোক আমার বাবাকে নিম্ন মানের ফার্নিচার পাঠিয়ে বাকি টাকা দিলেন মেরে। আমাদের আলমারির পেছনে বাড়ি দিলে তখন ধরাম ধরাম শব্দ হয়, আর আমার ২ বছরের ছোট ভাই খাট ধরে টান দিলে খাট চলে আসে বাতাসে। নিজের হকের টাকা এভাবে লুটপাট হতে দেখে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারলেননা আমার বাবা। পরিণাম – তিনি গিয়ে জনৈক ভদ্রলোককে তাঁর অভিযোগ জানালেন লিখিত ভাবে। এই নিয়ে অনেক বাগবিতন্ডার পর আমাদের অভিযোগ ও প্রমানাদির প্রেক্ষিতে ব্যাংক আবার আমাদের পুরানো ফার্নিচার ফিরিয়ে নেয়, এবং নতুন ফার্নিচার দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে দেয়। কিন্তু এর ফলে আমার বাবার সাথে সেই ভদ্রলোকের শুরু হয় এক কঠিন শত্রতা। শত্রতার প্রথম ধাপে আমাদের সাথে তার পরিবারের দেখা সাক্ষাত বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর ভয়াবহ পরিণতি আমরা জানতে পারি আমার বাবা বাংলাদেশে ফিরে যাবারও এক বছর পর।
ঘটনা নিম্নরুপঃ
দুবাই থেকে আমরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছি প্রায় এক বছর। আমি তখন পড়ি ক্লাস নাইনে।
ধীরে ধীরে আমরা নতুন করে আবার সব গুছিয়ে নিতে শুরু করেছি বাংলাদেশে। আমাদের ফ্লেটে বসেছে নতুন টাইলস। ঘরে এসেছে নতুন খাট, সোফা। দুবাই থেকে আনা হয়েছে অত্যাধুনিক ওয়াসিং মেশিন, ড্রায়ার, মাইক্রোওয়েভ, টিভি, ইত্যাদি।
এরই মাঝে একদিন সন্ধ্যায়, চা খাবার মাঝে, আমার মা কথায় কথায় আব্বুকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘তা আমাদের কানাডার এপ্লিকেশানের কি হল?’
আব্বু বিরস মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘রিজেক্ট হয়েছে হয়ত। কিছু তো জানালো না ।‘
এক কথা দুই কথায় এরপর ঠিক হল আব্বু আগামীকাল কানাডিয়ান এম্বিসিকে মেইল করবেন অগ্রগতি জানবার জন্য।
রিজেক্ট করো, কিন্তু জানাবে তো? ভদ্রতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। না-কি? – এই ছিল মেইলের মূল বক্তব্য।
কিন্তু মেইল করার দুদিন পর যে রিপ্লাই আমরা পাই তাতে আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ, আর আব্বুর টাক মাথায় হাত!
আমাদের মেডিকেলের জন্য নাকি কানাডিয়ান এম্বেসি থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল আব্বু দুবাইতে থাকতেই। কিন্তু তারা কোন উত্তর না পাওয়াতে এখনও আমাদের প্রোসেস আটকে আছে।
বুঝলাম জনৈক ভদ্রলোক আমার বাবাকে চিঠিটা দেননি ব্যাক্তিগত শত্রতার কারণে।
যাইহোক, এরপর আমরা কানাডিয়ান হাইকমিশনকে আবারও অনুরোধ করি আমাদের মেডিকেলের চিঠি পাঠাতে। আর এর প্রায় এক বছর পর, মার্চ মাসের ৬ তারিখ আমরা উড়াল দেই কানাডার উদ্দেশ্যে।এই ছিল আমাদের কানাডা আসার অভিজ্ঞতা।
Search term: Fahim Aziz, Canada_ashar_golpo, short story, bengali short story