নীচের ঘটনাটি কাল্পনিক। রফিক নামের কাওকে আমি চিনি না। বাস্তবে রফিক নামের কেও ছিল কি-না তাও আমি জানি না। তবে ঘটনার সাথে কিছু মিল খুজে পেলে তার জন্য লেখক দায়ী নয়। লেখকদের কাজই হল বাস্তব-অবাস্তব মিলিয়ে জগাখিচুরি বানিয়ে পাঠকদের গিলিয়ে দেয়া। আমি এখানে সেই কাজটিই করার চেষ্টা করেছি।।
এক বছর বয়েসী মেয়েটিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ফেসবুকে।
গুদুম গুদুম গাল নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে।
মাথায় তাঁর তালগাছ ঝুটি। আর পড়েছে টকটকে লাল রংয়ের একটি ফ্রকের সাথে সবুজ রংয়ের চুড়ি। খাটি বাঙালি ললনা হবার আপ্রাণ চেষ্টা!
মেয়েটিকে ছবিতে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রফিক। রফিকের চোখে শিশুটির জন্য একই সাথে মায়া এবং আতংক দেখা যাচ্ছে। নতুন মোবাইল ফোন হাতে নেবার পর যেমন একটা – ‘এই পড়ে গেল, এই পড়ে গেল’ অনুভুতি হয় – রফিকের চোখেও তখন সেই অনুভূতি। দেখে মনে হলো সে ভয়ে ভয়ে আছে – এই বুঝি কোল থেকে তাঁর মেয়ে পড়ে যাবে!
রফিক আমার গ্যাদা কালের বন্ধু।
বেশ অনেক বছর পর ফেসবুকের কল্যাণে তাঁকে আমি খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু সময়ের অভাবে কথা বলা হয়নি। বহুদিন পর এই ছবি দেখে আমি তাই তাঁকে ম্যাসেঞ্জারে বার্তা পাঠালাম- ‘কি রে, কেমন আছিস তুই? তুই কি বাংলাদেশে?”
দুদিন পর উত্তর – “নারে দোস্ত, ইতালি। স্যরি, কাজের জন্য ম্যাসেজ করার সময় পাইনি। কি অবস্থা তোর?”
সেই থেকে পুরনো বন্ধুত্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
দুই তিন মাস ধরে অল্প অল্প করে তাঁর কাছ থেকে যা জানা গেল তা নিম্নরুপঃ
বাবা মারা যাবার কারণে ইন্টারের পর রফিকের আর বেশী দূর পড়াশোনা হয়নি।
মা আর ছোট ভাই-বোনের সুখের কথা চিন্তা করে জীবন-জীবিকার তাগিদে সে পাড়ি জমিয়েছে ইতালি।
একটি ফুলটাইম আর দুটি পার্ট টাইম জব করে সে এখন বেশ ভালই আছে।
কিছুদিন আগে ছোট বোনের বিয়েও দিয়েছে ঘটা করে।
ছোট ভাইটাকেও বেসরকারি এক ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ-তে ভর্তি করিয়েছে নিজের ঘাম বেঁচা টাকা দিয়ে।
দুঃখ খালি একটাই, সময় মত টাকা জোগাড় করতে না পারায় বোনের বিয়ে সে মিস করেছে। অবশ্য এর মাঝে আনন্দের ব্যপার হলো, বোন তাঁর এখন বেশ ভাল আছে। খুবই ভাল এক স্বামী পেয়েছে। সেই সাথে সে তিন বছর আগে দেশে গিয়ে বিয়ে করেছে, অনেক কাঠ-খর পুড়িয়ে ইতালির পাসপোর্ট পেয়েছে, এবং বউকে দু’বছর আগে বিদেশে নিয়ে এসেছে।
ইতালিতে থেকে দেশের খাওয়ার কষ্টটা তাই তাঁকে এখন আর ভোগ করতে হচ্ছে না।
কথার মাঝেই আবার বের হয়ে আসে তাঁর কাজের কিছু রোম-হর্ষক দৃশ্য।
আগে সে একটি বিস্কুট ফ্যাক্টোরিতে ফুলটাইম কাজ করার সাথে সাথে একটি পেট্রোল পাম্প আর কফি শপেও পার্টটাইম কাজ করত।
একদিন রাতে সেই পট্রোল পাম্পে ডিউটি দেবার সময় এক বিদেশী এসে বন্দুক ধরে বলে – “টাকা পয়সা যা আছে এখনই বের কর!”
ভয়ে ভয়ে টাকা এগিয়ে দিতেই বন্দুকের বাট দিয়ে সেই আততায়ী তাঁর মাথায় দিলো এক বাড়ি। সেই জ্ঞাণ ফিরল প্রায় ২ দিন পর হাসপাতালে।
এরপর থেকে সে পেট্রোল পাম্পের জবটা বেশ কিছুদিন ধরে ছাড়ার চিন্তা ভাবনা করছে। তাঁর স্ত্রী বিশেষ করে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খুবই আপসেট। তাঁর কিছু হয়ে গেলে এই ছোট মেয়ে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন সেই নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই!
স্ত্রীর কথা শুনে রফিক শুধু মিটিমিটি হাসে। তাঁর স্ত্রী ভাল করেই জানেন রফিক কেন এখনই কাজটা ছাড়তে পারছে না।
আগামী ঈদে বাংলাদেশে মা-ভাইকে কিছু টাকা পাঠাতে হবে। এখন কাজ ছাড়লে সেটা সম্ভব হবে না।
তাছাড়া ফ্যাক্টোরিতে কাজ করতে করতে তাঁর হাতের হাড়েও ছোটখাটো চিড় দেখা দিয়েছে।
ডাক্তার তাঁকে কিছুদিন রেষ্ট নিতে বলেছেন বটে। কিন্তু একই কারণে সে ব্যাপারটা তাঁর স্ত্রী ও ডাক্তারের কাছ থেকে গোপন করে গেছে। কি দরকার অকারণে সবাইকে চিন্তায় রাখার?
উল্লেখ্য, সেদিন রাতে মায়ের সাথে কথা বলার সময় সে জেনেছিল মায়ের চিকিৎসার জন্য আরো কিছু টাকা লাগবে। ।”আগামী মাসেই পাঠাচ্ছি” – বলে সে বেশ হাসিমুখেই তাই মা’কে বলেছে – “আমি খুব ভাল আছি”।
এরপর চলে গেছে বেশ কিছুদিন।
অলস দুপুরে আমি পেট ফুলিয়ে টিভি দেখতে বসেছি।
চারপাশে শুরু হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাব।
হঠাৎ দেখি আমার বন্ধুকে দেখাচ্ছে টিভি-তে। সে বাংলাদেশে গিয়ে আটকা পড়েছে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে সাংবাদিকদের। আজও তাঁর মেয়েকে তাঁর কোলে দেখা গেল। টিভি ক্যামেরার দিকে গুদুম গুদুম গাল নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।
তাঁর বাবা মেয়ের সামনেই সাংবাদিকদের চেঁচিয়ে বলছে – আমরা বাংলাদেশের রেমিটেন্স যোদ্ধা। পাক ইয়্যুর সিস্টেম।
স্বাভাবিকভাবেই সুশীল সমাজের বাসিন্দা হিসেবে ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেই ভাল লাগেনি।
বন্ধুকে কল দিয়ে তাই কুশলাদি বিনিময়ের সাথে ঝাড়িও দিলাম বেশ কয়টি। উত্তরে সে কাঁদতে কাঁদতে যা বলেছিল তাতে তাঁকে শান্তনা দেবার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ঘটনা নিম্নরুপঃ
ইতালি থেকে রওনা দেবার পর কেটে গেছে প্রায় ১১ ঘন্টা।
রফিক সহ শত শত বাঙালি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ইমিগ্রেশানের জন্যে।
হঠাৎ একজন তরুন মত পুলিশ অফিসার এসে কিছু যাত্রীকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। কিছু সময় পর হলেও বোঝা গেল, এয়ারপোর্ট থেকেই এই সদ্য ইতালি ফেরত যাত্রীদের দুটি দলে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল সেদিন।
এক দল সাধারণ যাত্রী, যাদের বাপ-দাদার গুটির জোড় কম। বাংলাদেশে ঢুকতে হলে তাদের পাঠানো হবে হজ্জ ক্যাম্পে কোরেন্টাইনে।
আরেক দল মুক্ত যাত্রী – এদের বাপ-দাদার গুটির জোড় বেশী। গুটির জোড়ে তারা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি যাবে নিজ বাড়িতে।
আমার বন্ধু সহ বেশির ভাগ যাত্রীর-ই গুটির জোড় কম থাকায় তাদের পাঠানো হলো হজ্জ ক্যাম্পে।।
সকাল ৮ টায় হজ্জ ক্যাম্প পোছানোর পর দেখা গেল হজ্জ ক্যাম্পের ভেতরটা বেশ ময়লা। মশা মাছি সেখানে গিজগিজ করছে। প্রথমেই একজনকে বাথ্রুমে ঢুকে ছুটে বেড়িয়ে আসতে দেখে গেল নাক চেঁপে। তার সাথে যোগ হয়েছে .১০-১৫ টা গ্যাদার ট্যা ট্যা কান্না। গ্যাদাদের দেখেই বুঝা গেল বেশ খিদে পেয়েছে। সমস্যা হল বেশির ভাগ গ্যাদার-ই খাওয়া আটকা পড়েছে লাগেজের ভেতরে। কথা বলতে পারে না বলে বেচারারা মনের ভাব খুলে ও বলতে পারছে না। এরই মাঝে আবার রুমের ভেতরে ভালো বসার জায়গা না থাকায় তা নারী ও শিশুদের ছেড়ে দিয়ে ছেলেরা চলে গেছে বাইরে। রফিককেও দেখা গেল তাদের সাথে বাইরে গল্প করছে আর চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে।
রফিককে দূর থেকে দেখে তাঁর স্ত্রীর ভ্রু কুঞ্চিত হল।।
ভদ্র মহিলা বারবার মানা করা সত্ত্বেও তাঁর স্বামী প্লেনের টিকেট বাতিল করেনি।
কি হতো এক হাজার টাকা পানিতে পড়লে? কিছু টাকা কি ফেরত পাওয়া যেত না! বুঝলাম গাধা খাটুনির একটি টাকাও জলে ফেলতে তাঁর স্বামীর বুক ফেটে যায়। কিন্তু জীবনের আগে তো টাকা হতে পারেনা! এমন কিছু যে হবে তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন।
এসব চিন্তা করতে করতেই ভদ্র মহিলার গলা শুকিয়ে গেল। তিনি দূর থেকে হাত নেড়ে রফিকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন।
এক সময় রফিক তা দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এলে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন – কয়টা বাজে?
রফিকের হাতে তখন ইতালির সময়। হিসেব করে বলল – প্রায় ৯ টা।
আর কতক্ষণ এখানে আটকে রাখবে?
রফিক কিছু বিমর্ষভাবেই বলল – বুঝতে পারছি না। কেও কিছু বলছে না।
কথাটা বলার মাঝে রফিক তাঁর মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। যাত্রার ধকলে মেয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা প্রায় ১১ ঘন্টা না খেয়ে আছে।
রফিকের আদর পেয়ে মেয়েটি চোখ খুলে বড় বড় করে তাকিয়ে বলল – বা, মাম।
রফিক মিটিমিটি হাসি দিলেন। মেয়ে নতুন কথা বলতে শিখেছে। বাবা বলতে পারে না এখনও। মাম মানে পানি। বা, মাম মানে বাবা পানি খাব।
মেয়ের পানির খোঁজে রফিক তাই ঘর থেকে বের হয়ে এল।
এদিক ওদিক ঘুরে একজন পুলিশ অফিসারকে পাওয়া গেল। তাঁর সাথে কথোপকথন নিম্নরুপঃ
ভাই, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?
এই তো বেশীক্ষণ না। আপনাদের করোনা আছে কিনা পরীক্ষা করেই ছেড়ে দেয়া হবে।
কিন্তু আমাদের তো রোম থেকে ওরা চেক করেই পাঠিয়েছে!
হুম, কিন্তু প্লেনেও তো কাওকে এই ভাইরাস ধরতে পারে।
আমাদের চেক করেন তাহলে। ডাক্তার কোথায়?
ডাক্তার আসছে।
ভাই, আমার মেয়ের জন্য একটু পানি লাগবে। একটু পানির ব্যাবস্থা করেন।
রফিকের এই অনুরোধে তরুন অফিসারকে কিছুটা অপ্রস্তুত বলে মনে হলো। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, এখানে তো পানি নাই।
অফিসারের কথা শুনে রফিক কিছুটা বিস্মিত হল। এতজন মানুষকে এখানে এনে রেখেছে অথচ পানির ব্যাবস্থা করেন নাই? – জাতীয় একটি তীর্যক প্রশ্ন করবে ভেবেও নিজেকে সামলে নিল। গদগদ হয়ে বলল – ভাই, আমাকে একটু পানি আর খাওয়া ম্যানেজ করে দেন। আমার বাচ্চা মেয়েটার অনেক খিদে পেয়েছে।
“হুম, দেখছি” বলে অফিসার উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন। রফিক ক্যাম্পের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পানির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
এরপর চলে গেছে আরও দীর্ঘ এক ঘন্টা। রফিকের স্ত্রীকে দেখা গেল ইতালির পাসপোর্ট দিয়ে মেয়েকে বাতাস করতে। মেয়েটি একটু পর পর “মাম, মাম” করছে।
বাজে তখন প্রায় দশটা।
অফিসার ভদ্রলোককে দেখা গেল বেশ কিছু পানির বোতল নিয়ে এদিকে আসছেন। তাঁকে দেখে প্রায় সবাই ছুটে গেলেন পানির বোতল কেড়ে নিতে। রফিকও দৌড়াল প্রাণপণে। পানির বোতল সেদিন সে পেয়েছিল কি-না আমার জানা নেই। শুধু জানি দুপুর দুইটার পরও মেয়ের জন্য খাওয়া না পেয়ে সে বলেছিল –
আমার বাচ্চা আমার কলিজা, আমার জীবণ। পাক ইয়্যুর সিস্টেম
Search term: COVID-19, short story, Fahim Aziz