ঢিল মারি তোর টিনের চালে (পর্ব ১)

গভীর রাতে বাড়িতে এক পশলা যুদ্ধ হয়ে গেল। 

ছেলে কিছুতেই ঘুমুবেনা। 

এদিকে আমি আর গিন্নিও  গোঁ ধরে বসে আছি – তাঁকে ঘুমুতেই হবে!  

দীর্ঘ সংগ্রামের পর যুদ্ধে জয়ী হয়ে সবেমাত্র একটু হাপ ছেড়ে বেঁচেছি! 

প্রায় সাথে সাথেই বিকট ‘পে-পু , পে-পু’ শব্দ। 

পরিনাম – ছেলের চোখ আবার সটাং করে খুলে গেল! 

আমি ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। 

জগতের সব মানুষকে জাগিয়ে এখনই কর্তাদের আগুন নেভাতে যেতে হলো! 

আমি বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম।  

রাত দুটোর সময় আগুন কে লাগালো, আর কেই বা  ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িকে জায়গা দিচ্ছে না – জানা দরকার।    

ওমা!

চারপাশে শুনশান নিরবতা! অন্ধকার! 

আগুনের লেশ-বিন্দু তো নেই-ই, কোন গাড়ি ঘোড়াও চোখে পড়ল না যে পথ আটকাবে! 

তাহলে এই ‘পে-পু, পে-পু’ করার কারণ কি-রে বাপু! 

শালারা কি এত রাতে মই নিয়ে কারো গাছের বিড়াল নামাতে যাচ্ছে না-কি?!

ইচ্ছে করছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির ওপর এক হালি ডিম ছুঁড়ে মারি। 

উইন্ডশিলে জায়গা মত ডিম ছোঁড়া গেলেই কেল্লা ফতেহ! 

ওয়াইপার ব্লেড ফুল স্পিডে এদিক-ওদিক করেও তেমন লাভ হবে না। 

কুসুম ফেনা হয়ে লেগে থাকবে সর্বত্র।

আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে রাগে গঁজরাতে গঁজরাতে সোফায় বসলাম। গিন্নি আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল – “ ছেলে বড় হলে তোমার সাথে এসব নিয়ে অনেক লাগবে।”

– কি নিয়ে লাগবে?

– তুমি বলবে এরা সাউন্ড করে যাচ্ছে কেন? আর ছেলে বলবে তুমি কিভাবে জানো যে ওরা আগুন নেভাতে যাচ্ছে না? 

আমি গিন্নির কথায় সায় দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। 

আমার গিন্নির মাথা ভালো। 

সত্য কথা বলেছে।।

আমি ছেলের দিকে উদাস হয়ে তাকালাম।

ছেলের চোখে-মুখে ঘুমের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

সুতরাং আর ঘুম পাড়াবার চেষ্টা না করে আমি মোবাইল টেপা শুরু করলাম। ছেলের সাথে পাল্লা দিতে জ্ঞাণ বাড়ানো প্রয়োজন।

মোবাইলে খবরের কাগজ খুলতেই চোখ আটকে গেল এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদে। 

গ্রীণরোডে কার্নিশ থেকে পাথর খসে একজন নামাজীর মাথায় পড়েছে। 

ছয় তলা থেকে পাথর মাথায় পড়লে মৃত্যু অবধারিত।

 হয়েছেও তাই।

 আল্লাহ সেই ব্যাক্তিকে বেহেশত নসিব করুন। আমীন।।

দুঃসংবাদটি আমার মনে বেশ দাগ কাটলো। সেই সাথে শৈশবের দু’টি স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ায় খানিকটা অপরাধ বোধও আমাকে গ্রাস করে ফেলল।   

গ্রীণরোডের ছাদ থেকে অনাকাঙ্খিত জিনিষ-পত্র খসে পড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। 

লৌকিক এবং অলৌকিক কারণে বহুবার আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি।

বাড়ীর ছাদ থেকে বড় ভাইদের গোলাপী রংয়ের পটকা ফেলা, বা জ্বীনের হাতে কাজের ছেলের আছাড় খাওয়ার মত ভয়াবহ ঘটনার রাজসাক্ষী আমি। 

যাইহোক,  অন্য মানুষের গোমর ফাঁস না করে বরং নিজের কিছু কাহিনী শেয়ার করি। 

ঘটনা নিম্নরুপঃ

আমার শৈশবের একটা লম্বা সময় কেটেছে ঢাকা শহরের গ্রীনরোডে। 

“ভোজন বিলাশ” হোটেলের গলি দিয়ে ঢুকে একটু সামনে এগিয়ে – ডান-ডান-বামের (গলি) পর সবুজ রংয়ের এক বাড়িতে।. 

সেই বাড়িটি আজও আমার কাছে স্বপ্নের মত – অসাধারণ কিছু শৈশবের স্মৃতি দিয়ে ঠাসা।

আমার ধারণা, বাড়ির চার দেয়ালকে যদি কোন ভাবে হাসার ক্ষমতা দেয়া যেত, আমাদের সেই বাড়ি সারাদিন “হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ” করে হাসত ।    

যখনকার কথা বলছি, আমার বয়েস তখন ছয়-বা-সাতের আশেপাশে। 

আমাদের বাড়ির ছাদ ইট পাটকেল দিয়ে ভরা। 

বাড়িওয়ালার নাতিদের থাকার জন্যে ছাদে আলাদা করে ঘর নির্মান করা হচ্ছে।। 

একদিন দুপুরে ছাদে ঘুরতে গিয়ে দেখি ছাদ একেবারে খালি। 

শুধু ছাদের সাথে লাগোয়া তাল গাছে একটা বুড়ো কাক ঝিমুচ্ছে।   

কাকটিকে ঢিল মারার জন্য এক টুকরো ইট হাতে নিতেই চোখ গিয়ে পড়ল  বাল্যবন্ধু অয়নদের বাসার ওপর। ছোট-খাটো এক তলা বাড়ি। ছাদটা টিনের। স্বাভাবিকভাবেই মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হলো। কাকের বদলে ঢিল ফেলা হবে অয়নের চালে।

ঘটনার এই পর্যায়ে বলে রাখা ভালো যে, এই ঘটনার কিছুদিন আগে থেকে অয়নের সাথে আমাদের পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের কথা বলা  বন্ধ ছিল। কারণটা বেশ ভয়াবহ – আমরা ধর্মযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম!

বিষয়টা খোলাসা করি।।

অয়ন বয়সে ছিল আমার চেয়ে দেড়-দুই বছরের ছোট। সবে মাত্র কিন্ডারগার্টেন পেরিয়ে ক্লাস ওয়ানে উঠেছে।

একদিন বিকেলে পাশের বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দেখা গেল – মাঠের মাঝখানে এক হাত পানি। মাটি একেবারে ভেজা!

আগের রাতে তুমুল বৃষ্টি হওয়াতে এই বিপত্তি। 

অগত্যা ক্রিকেট ব্যাট-বল ঘরে তুলে রেখে আমরা মাটিতে আঁকা-আঁকির সিদ্ধান্ত নিলাম। 

পরিকল্পনামাফিক বাড়ির কর্তা ঘুমিয়ে আছেন দেখে, তাঁর মেহেদী গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে আনা হলো তুলি হিসেবে ব্যাবহার করার জন্যে। 

শিল্পের পথে হাঁটতে সেকালে আমাদের বেশ বেগ পেতে হতো বৈ-কি। তুলি হিসেবে সাধারণ একটা গাছের ডাল ভাঙ্গার কারণেও অনেক বকাঝকা শুনতে হতো! আমরা এখনকার জেনারেশানের মত এত সাহসী ছিলাম না। মুখ বুঁজে সব শুনতাম, এবং পরদিন একই কাজ করে আবার বকা খেতাম।

যাইহোক, ডাল জোগাড়ের পর মনের আনন্দে শুরু হল আমাদের আঁকা-আঁকি।  

শুরু হলো বাড়ি, গাছ, গরু, নদী দিয়ে। এরপর নদীর পাশে রাস্তা। সেই রাস্তা গিয়ে শেষমেষ পৌছলো পাড়ার মসজিদে।  

তবে ছবির রাস্তা মসজিদের পৌছবার পরই একটা সমস্যা দেখা দিল। 

অয়ন ছিল খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। 

নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে সে তাই মসজিদের চাঁদ-তারার পাশে বেশ ঘটা করে একটি ক্রসও জুড়ে দিলো। 

শিশুদের মাঝে সাধারণত territorial ব্যাপারগুলো খুব দ্রুত escalate করে। 

আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। 

কিন্ডারগার্টেনের একটি ছেলে আমাদের মসজিদের পাশে ক্রস আঁকায় আমরা ধর্মযুদ্ধে পতিত হলাম। 

“জিসাস” বলে অয়ন আঁকে ক্রস, তো “আল্লাহ-হু-আকবার” বলে আমরা আঁকি চাঁদ-তারা। 

‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ – টাইপ অবস্থা।

এভাবে কতক্ষণ চলেছিল আমার খেয়াল নেই। 

হঠাৎ চাঁদ-তারা এঁকে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি অয়নের মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আমাদের দিকে তাঁকিয়ে আছেন। কোমড়ে হাত। 

তিঁনি আমাদের হাঁসির প্রতিউত্তরে পাল্টা হাসি দিলেন না। তার চোয়াল আরো শক্ত হলো

এরপর আর কোন কথা বলে তিনি অয়নকে হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে ‘ধরাম’ করে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলেন।

এরপর আর অয়নের সাথে আমাদের দেখা হয়নি প্রায় তিন মাস।। 

এবার মূল ঘটনায় ফিরে আসি।।

ছাদের রেলিং ধরে অয়নদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। 

কেন যেন মনে হলো, পাঁচ তলার ওপর থেকে ওদের টিনের চালে একটা ইট ফেললে বেশ মজা হবে। 

 যেমন ভাবা তেমন কাজ।

ছাদের সব থেকে বড় ইটের টুকরাটি খুঁজে বের করে আমি “সাম্প্রদায়িকতার খেতা পুরি” – চিৎকার করে অয়নদের টিনের চালের ইট ছুঁড়ে মারলাম! 

দুই মূহুর্ত পরের কথা।।

সারা এলাকা প্রকম্পিত করে “ধুরুমমম” শব্দে সেই ইট অয়নদের বাড়ির চালে পতিত হলো। 

তাল গাছের আলসে কাককেও জীবণ বাঁচাতে ছুটে পালাতে দেখা গেল।

অয়নদের বাড়ির কাজের মেয়েকে ভয় পেয়ে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। 

বিভ্রান্ত এলাকাবাসীদের বারান্দায় এসে চারপাশে পিটপিট করে তাকাতে দেখা গেল!

আর আমাকে?  – কাঁপা কাঁপা পায়ে, দুরুদুরু বুকে, কেও দেখে ফেলার আগেই ছাদ থেকে পালাতে দেখা গেল। 

আমি যে সিঁড়ি ধরে এক সাথে তিন স্টেপ দৌড়ে নামতে পারি, সেদিনই তা প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম!

সত্যি বলছি, ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন এলাবাসীর সাথে সাথে আমারও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। 

পাঁচ তলার ওপর থেকে টিনের চালে ইট পড়ার শব্দ যে এত প্রকট হতে পারে, সে সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্রও ধারণা ছিল না! 

আনন্দের সংবাদ হচ্ছে, সে যাত্রায় আমি বেশ বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। 

কেও আমাকে আ-কামটি করতে বা পালিয়ে যেতে দেখেনি।

দেখে থাকলে অয়নের মা অবশ্যই আমার নামে মামলা ঠুকে দিতেন। 

যাইহোক, শৈশবের এই ঘটনা থেকে সেদিন জীবণের দু’টি মহামূল্যবান শিক্ষা গ্রহণ করছিলাম। 

শিক্ষা একঃ

ক)  টিনের চালে এত বড় ইট ফেলতে নেই। ফেলতে হবে ছোট ইট। 

খ) ইট ফেলেই রেলিংয়ের থেকে দূরে সরে মাটিতে বসে পড়তে হবে। তাহলে নীচের থেকে দেখা যাবে না – কে ইট মেরেছে। 

শিক্ষা দুই, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। 

শত খারাপের মাঝেও, এই ঘটনার কারণেই প্রায় তিন মাস পর আমরা আবার অয়নকে আমাদের মাঝে ফিরে পাই। 

ঘটনা নিম্নরুপঃ

অয়নদের বাসায় ঢিল মারার পরদিন ছিল শুক্রবার। 

সে আমলে ছুটির দিনগুলোতে ধনী-গরিব সবাই মিলে দুপুরে বাংলা-সিনেমা গলাধঃকরণ করত। 

সেদিন বিকেলে ক্রিকেট খেলার সময় দেখা গেল অয়নদের জানালা খোলা। 

জানালার পাশে বসে অয়নের মা সিনেমা দেখতে দেখতে চুলে তেল মালিশ করছেন। 

ভদ্রতার খাতিরে পাড়ার বড় ভাই  (উঠানের মালিকের ছেলে এবং অয়নদের বাড়িওয়ালা। তিনি আমাদের ধর্মযুদ্ধ সম্পর্কে জানতেন না। আমরা যখন ক্লাস টু-তে পড়ি তিনি তখন এইট এ পড়েন। তবে তার ছোটভাই আমাদের বয়েসি হওয়াতে তিনিও আমাদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন) ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। 

– আংটি, কি অবস্থা, কেমন আছেন?  

– হ্যা বাবা, আর বলো না! গতকাল আমাদের চালে কি যেন একটা পড়েছিল। কাজের মেয়েটা বাড়িতে  একা ছিল। অনেক ভয় পেয়েছে।

– ওহ হো! ভয় পাবারই কথা। কি পড়েছে কিছু বুঝেছেন?

– না, বুঝলাম না। কাজের মেয়ে বলছে জ্বীন। কিন্তু এসব কি বিশ্বাস হয়? আমার মনে হয় গাছের থেকে কাঠাল পড়েছিল। 

– হুমম, কিন্তু কাঁঠাল কি এত জোড়ে পড়বে? আম্মা রান্না করছিলেন, ছুটে এসে দেখে আপনাদের কাজের মেয়ে সিড়ির চিপায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।  

– কি জানি বাবা? কিছু একটা তো পড়েছে। হয়ত ছাদ থেকে ইটের টুকরা হবে?

– হুমম, তা আংটি অয়ন কৈ? অনেক দিন হয় দেখি না ও-কে? 

– অয়ন তো ঘরেই আছে। বই কিনে দিয়েছি – বই পড়ে। তোমাদের কিছু ছেলে ওর সাথে ধর্ম নিয়ে মারামারি করেছিল। তাই ওকে আর বের হতে দেই না। 

ভদ্রমহিলার এই কথা শুনে বড় ভাই বেশ হতভম্ব হয়েই বলেছিলেন, কি বলেন আংটি?! আমি তো জানি না! আমি ভাবলাম শরীর খারাপ বা পড়াশোনার জন্য বের হচ্ছে না! এই ফাহিম, এই দিকে আসো তো! অয়নকে কে মেরেছে?

এরপর এক কথা আরেক কথায় বের হয়ে এসেছিল প্রকৃ্ত ঘটনা। 

আমরা আংটি কেন রাগ করেছেন বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হই। তাঁকে এবং অয়নকে স্যরি বলি। 

বড় ভাই সেদিন আমাদের বুঝিয়ে বলেছিলেন, ধর্ম নিয়ে অধর্মের মত ব্যাবহার করা ঠিক না। সবার তাঁর নিজ-নিজ ধর্ম মেনে চলার অধিকার আছে। আমাদের একের ধর্মের প্রতি অন্যের সম্মানবোধ থাকতে হবে।

জীবণ থেকে নেয়া এই শিক্ষা পরবর্তীতে অনেক কাজে এসেছিল। 

ধর্ম নিয়ে কাওকে কিছু বলার আগে আমি এখনো দুইবার চিন্তা করে দেখি- ঠিক করছি তো? 

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *