আজিজ সাহেবের বাড়িতে আজ বড় ধরনের একটি দূর্ঘটনা ঘটে গেছে।কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে সাপে কেটেছে।
ঘটনার খবর শুনে ড্রাইভার সাহেব দৌড়ে গেছেন ডাক্তার ধরে আনতে। যদিও দৌড়ে যাবার কোন দরকার ছিল না। ঘরে টেলিফোন আছে। ফোন করে দিলেই ডাক্তার সাহেব ছুটে চলে আসতেন। অধিক উত্তেজনার বশে মনে হয় তার ফোনের কথা মনে ছিল না। ডাক্তার সাহেব থাকেন আজিজ সাহেবের পাশের ফ্লেটে।
আজিজ সাহেব ময়মনসিং পলিটেকনিকের অধ্যাপক। কাজের সুবিধার্থে তিনি পরিবার নিয়ে ময়মনসিংয়েই থাকেন। তাকে সরকারের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে একটি বিশাল বাড়ি। এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা আট। আজিজ সাহেব, তার স্ত্রী, ৪ মায়াবতী কন্যা, মালি, দারোয়ান, এবং ড্রাইভার। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে অবশ্য এই সংখ্যা ৯ হয়ে যায়। কারণ সে সময় আজিজ সাহেবের বড় মেয়েও ঢাকা থেকে বাড়ি বেড়াতে আসে। তার বড় মেয়ে ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়াশো্না করছে।
এই মুহূর্তে আজিজ সাহেব তাঁর শোবার ঘরের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগে তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে দারোয়ান ও মালি। তাকে ঘিরে আছে তাঁর স্ত্রী ও চার কন্যা। তাঁর স্ত্রীর চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। চার কন্যাও বাবাকে মৃত্যুপথযাত্রী ধরে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে। বড় মেয়ে দুটি মায়ের পাশে দাঁড়ানো।তারা একটু পরপর ওরনা দিয়ে চোখ মুছচে। আজিজ সাহেবের সেঝো-মেয়েটা একটু বেশী আবেগী। সে রীতিমত মরা-কান্না শুরু করেছে। কান্নার মাঝে মাঝে বিলাপ করে সাপ সংক্রান্ত কি একটা মন্ত্র-ও বলছে। তার মেয়ের দৃড় বিশ্বাস, এই মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ নামানো যায়!“ডোরা সাপের কোড়া বিষ – বদ্দি আসলে বইলা দিস!” আজিজ সাহেবের ছোট মেয়েটা সাহসি। তবে আজ সেও “আব্বা আব্বা” করে কাঁদছে।
আজিজ সাহেবের বুকটা হঠাৎ বেদনায় ভরে উঠল। এই ফুটফুটে মেয়ে গুলো্কে ছেড়ে তার চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এদের সাথে তার আর কোনদিন দেখা হবে না, মাথায় হাত রেখে আর বলা হবে না ‘মা-রে চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’, বা তাদের কাছ থেকে ইচ্ছে করলেই আর ‘বাবা’ ডাক শুনতে পাবেন না! জীবনকালে যে জিনিষগুলোকে স্বাভাবিক, বিরক্তিকর মনে হয়, মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে তাকেই এত সুন্দর মনে হয় তা কে জানত? জগৎটাকে হঠাৎ তার কাছে বড় নিষ্ঠুর মনে হয়।কবি যেন কি বলেছিলেন? ‘বাঁচিতে চাই না আমি’, নাকি ‘মরিতে চাইনা আমি’? বাঁচতে কেন চাইবে না?
আজিজ সাহেবের মাথা ঝিম-ঝিম করছে। মরার আগে পানি পিপাসা পায় শুনেছিলেন। কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করে শুনেননি। হঠাৎ তিনি পানি পিপাসা বোধ করলেন।। করুন সুরে বললেন,
‘পানি, পানি’।
দারোয়ান ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এল -‘স্যার, পানি’
দারোয়ানের গলা শুনে আজিজ সাহেব চোখ মেলে তাকালেন। আজিজ সাহেবের ইচ্ছা করছে দারোয়ানের দু-গালে দু’টা চড় বসিয়ে দিতে। আজিজ সাহেবের আজকের এই পরিণতির জন্য এই বাঁদরটা বহুলাংশে দায়ী।
আজিজ সাহেবকে আজ কাজ থেকে বাড়ি আনার দ্বায়িত্ব এই বাঁদরের। তাঁর স্ত্রীর গাড়ি দরকার বলে ঠিক করেছিলেন আজ হেটেই বাড়ি ফিরবেন।
রাতের বন-জঙ্গল দুষ্টু লোকের আবাস। এর থেকে আজিজ সাহেবকে হেফাজতে রাখার জন্য দারোয়ানকে তাই একটা বড় সাইজের লাঠিও কিনে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সময় মত সাপ দেখা দূরে থাক, সাপটাকে লাঠি দিয়ে একটা বাড়িও মারতে পেরেছে বলে মনে হয় না। যে মানুষ একটা সাপ মারতে পারে না, বিপদের সময় সে মানুষ কিভাবে মারবে কে জানে?
এমন সময় রুমে ডুকলেন ডাক্তার।।
ডাক্তার সাহেব যখন রুমে ডুকলেন, মালি ও দারোয়ান তখন প্রবল উৎসাহে কাপড় দিয়ে আজিজ সাহেবের হাত-পা শক্ত করে বাঁধছে। উদ্দেশ্য – বিষ যেন কোন ভাবেই উপরে উঠেতে না পারে। সমস্যা একটাই – সাপ ঠিক কোথায় কেটেছে তা এখনও বোঝা যাছে না। আজিজ সাহেব বলেছেন পায়ে। কিন্তু এখন ও কোন কাটা-ছেঁড়া খুজে পাওয়া যায়নি। মালি এবং দারোয়ান অবশ্য এখনো হাল ছাড়েনি। তারা আজিজ সাহেবের হাত-পা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে এবং একটু পরপরই “এই যে পাইছি মনে হয়” বলে চেঁচিয়ে উঠছে। যদিও প্রকৃ্তপক্ষে এখনও কোন ছিদ্র পাওয়া যায়নি – সবগুলোই ছিল ফলস অ্যালার্ম। আপাতত তাই ছিদ্র পাবার আগে সতর্কতাস্বরুপ আজিজ সাহেবকে যতটা সম্ভব কাপড় দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে।এতে বিষ উপরেই যাক বা নিচেই যাক, কিছু আসে যায় না।
সেই গিটের কারণেই হোক, বা বিষের কারণে – আজিজ সাহেবের হাত-পা নীল হয়ে ফুলে উঠেছে।
ডাক্তার সাহেব চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজিজ সাহেব, কেমন বোধ করছেন?’
ডাক্তার সাহেবকে দেখেই আজিজ সাহেবের বুকে পানি ফিরে এল। তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, এই যাত্রায় বেঁচে গেলে তার চার মেয়ের এক মেয়েকে অবশ্যই ডাক্তার বানাবেন।
আজিজ সাহেব ডাক্তারের প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না। শুধু মাথা এপাশ-ওপাশ করলেন। যার মানে – অবস্থা ভাল না।
ডাক্তার সাহেব আরো গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি সাপ কেটেছে কেও দেখেছেন?’
দারোয়ান সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ডাক্তারকে যে বর্ণনা দিলেন, তার মূলভাব নিম্নরূপ–
‘ঘটনা ঘটার সময় সেখানে স্যার এবং দারোয়ান ছাড়া অন্য কোন পশু-পক্ষী উপস্থিত ছিল না। রাতের অন্ধকারে কি সাপ কেঁটেছে তা ঠিক বোঝা যায়নি। তবে, স্যার(আজিজ সাহেব) ‘সাপ! সাপ!’ বলে চিৎকার দেয়ার সাথে সাথেই দারোয়ান তার হাতের লাঠি দিয়ে সাপের মাথায় ‘দড়াম্’ করে একটা বাড়ি দিয়ে, স্যারকে কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে এসেছে।’
শুধু তাই নয়।সে আরো জানালো – ‘ইমুন বাড়ি দিছি গো স্যার, হাতির মাথায় পড়লে হেইও মুইরা যাইত।’
দারোয়ানের আরো জানাল, সে নিশ্চিত – যে সাপ এবং তার লাঠি, দুই-ই এই মুহূর্তে পড়ে আছে ঘটনাস্থলে!
কিন্তু শেষের কথাটা বলার পরই লাগল একটা ঘাপলা। ডাক্তার সাহেব বলে বসলেন – চিকিৎসা শুরু করবার আগে তিনি সাপটা দেখতে চান। হতে পারে সাপটার কোন বিষ ছিল না?
ডাক্তার সাহেবের উপস্থিত বুদ্ধিতে আজিজ সাহেব অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি সেই মুহূর্তে চার সদস্য বিশিষ্ট মরা-সাপ-উদ্ধার-কমিটি গঠন করলেন।এই কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিশ্চিত করবে আজিজ সাহেবকে কোন সাপে কেটেছে। কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ডাক্তার। আর সদস্য – মালি, দারোয়ান এবং ড্রাইভার।।
২০ মিনিট পরের কথা।
রাতের অন্ধকার ভেদ করে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে চার সদস্য্ বিশিষ্ট দলটি। দলের একবারে সামনে রয়েছে দারোয়ান। তিনি সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এরপরই আছে ডাক্তার, ড্রাইভার ও মালি। মালির মুখ তাদের মাঝে সব থেকে গম্ভীর। তার ঘরে বউ-বাচ্চা আছে। এত রাতে মরা সাপ খুঁজতে যাওয়া তার কাছে নিতান্তই ছেলে-মানুষী বলে মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে- এই ডাক্তার ছোড়াটাকে ডেকে আনাটাই আসলে সব থেকে ভুল হয়েছে।সাপের চিকিৎসা করবে ওঝা।ডাক্তার সাপের কি বোঝে? একটা ওঝা পাওয়া গেলে তার স্যার এতক্ষণে সুস্থ হয়ে ফুটবল খেলতেন। তার থেকেও বড় কথা, সাপটা যদি সত্যিই মরে থাকে, তাহলে মরা-সাপের পরিবার নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাকে খুঁজতে বের হয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল হলে এতক্ষণে হয়ত পেয়েও গেছে, আর এখন ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। মালি ভাবছে ডাক্তার সাহেবকে ডেকে বিনিত গলায় বলবে নাকি – “স্যার একটু বাথরুম পেয়েছে। এই আমি যাব আর আসব।” –এরপরে ডাক্তার সাহেব – ‘ঠিক আছে’ বলার সাথে সাথে এক দৌড়ে বাড়ি! আজিজ সাহেব যদিও কড়া করে বলে দিয়েছেন, ‘সাপ না নিয়ে যেন বাড়ি ফেরা না হয়’।কিন্তু জীবনের আগে তো চাকরি হতে পারে না। চাকরি গেলে যাক!মালি আবার ভাবতে লাগল, কিন্তু ডাক্তার সাহেব যদি বলেন – ‘জঞ্জলে কেও দেখবে না। গাছের পিছনে করে আসেন। আমরা অপেক্ষা করব।’
তাহলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!মালি তাই ঠিক করল কাওকে কিছু জিজ্ঞাস করবে না।কিছু না বলেই হঠাৎ উল্টো ঘুরে দৌড়! কিন্তু দৌড় দেবার ঠিক আগ মূহুর্তে তাকে থমকে দাঁড়াতে হল। ৫ ফুট দূরে দারোয়ানের লাঠি দেখা যাচ্ছে। লাঠির নিচে পড়ে আছে কমলা রঙের এক নিস্প্রান দেহ!
দম বন্ধ করে লাঠিটির কাছে এগিয়ে গেল দলটি। চারপাশে শুনশান নিরবতা।
লাঠির দিকে ভাল করে আলো ফেললেন ডাক্তার।জানা দরকার মৃত সাপটি বিষাক্ত নাকি নির্বিষ? কিন্তু একি!!-
লাঠির নিচে পড়ে আছে – পেটিকোটের ফিতা!
Search terms: Bengali Short Story, Fahim Aziz, Ekti Shaper Golpo, funny bengali story