বেশ কিছুদিন আগে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক খুলতেই দেখি চারপাশে ‘শিশুকাল”-সংক্রান্ত পোষ্ট!
প্রথমে ভেবেছিলাম আজকে বোধ হয় “শিশুকাল” দিবস। কিন্তু ইন্টারনেট ঘেটে এই জাতীয় কিছু পেলাম না।
মুক্ত-বাজার অর্থনীতির হাত ধরে, এই ‘দিবস’ বিষয়ক জটিলতাটাও কিভাবে যেন আমাদের সমাজে ঢুকে পরেছে। চুমু দেয়া থেকে শুরু করে সুন্নাতে খাতনা, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে তারেকের বিদেশ পলায়ন – সব ব্যাপারেই আজ একটা না একটা দিবস থাকা চাই-ই চাই। তবে রাজনীতির এই no man’s land-এ না গিয়ে বরং আমার মুল বক্তব্যে ফিরে আসি। কেও যেন না ভাবেন তাঁর কুরসি নিয়ে টান দিয়েছি! নাহলে আমার প্রথম বইটি-ই অদৃশ্য হাতের ছোয়ায় গুম হয়ে যাবে!
যাইহোক, ইন্টারনেট ঘেঁটে যেহেতু এই জাতীয় কোন দিবসের সন্ধান পাওয়া গেল না – ধরে নিচ্ছি, সেই লেখাগুলো এমনি এমনি লেখা, আর আমার এই লেখাতে বিশেষ কোন বাধ্যবাধকতা থাকার প্রয়োজন নেই। তারপরও যদি কিছু থেকে থাকে, পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আমার এই অপারগতাকে ক্ষমা করে দেবার জন্য। আমি মূল লেখা শুরু করছি-
স্মৃতিচারণ বিষয়ক পোষ্ট পড়তে আমার বেশ ভাল লাগে। আমার বিশ্বাস -একজন লেখক কখনোই কলম হাতে নিয়ে মিথ্যা কথা লেখতে পারেন না। অস্বাভাবিক বা অবাস্তব কোন গল্প লেখার সময়ও তিঁনি তাঁর পাঠককে জানাতে চান তাঁর মনে লুকিয়ে থাকা কিছু ব্যাতিক্রমি কল্পনাকে। হয়ত এদিক-ওদিক একটু বাড়িয়ে-কমিয়ে বলেন। কিন্তু সেই বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলার মাঝেও এক ধরণের আবেগ ও বিশ্বাস কাজ করে। আর এ কারণেই আমার মনে হয়, একটি স্মৃতিচারণমূলক রচনা হচ্ছে একজন মানুষ সম্পর্কে গভীর ভাবে জানার সর্বশ্রেষ্ট উপায়।
চিন্তা করলাম, আমিও তাহলে আমার জীবনের কিছু স্মৃতিচারণ করি। হয়ত কোন এক বর্ষাস্নাত অলস বিকেলে আমার নাতি-পুতি এক কাপ কফি হাতে সেটা পড়ে মজা পাবে!
যাইহোক, মূল ঘটনায় ফিরে যাই –
আমার শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে ধানমন্ডির গ্রীনরোডে। ছায়া ঘেরা শান্ত এক বাড়িতে। সে বাড়ির সামনে ছিল – বিশাল এক আধা-মরা আম গাছ, আর একটুখানি উঠোন। উঠোনের ঠিক সামনেই বসার ঘর। আর বসার ঘরের সাথে লাগানো ছোটখাট একটা বারান্দা। বারান্দার গ্রিলের রঙ ছিল সবুজ।সেই গ্রিল ধরে আমরা কারণে-অকারনে ঝুলা-ঝুলি করতাম। আমরা বলতে বুঝাচ্ছি-আমি, আমার বন্ধুরা, বাড়িওয়ালার নাতি, ঈদের আগে কাজিনরা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা গেল বাড়ির সামনের দিকের বর্ণনা। বাড়ির পেছনেও ছিল ছোটখাটো একটি উঠোন। সেটি ছিল সম্পূর্ণই বাড়ির কাজের মেয়েদের দখলে। সেখানে যেতে হত রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে। কোন এক বিচিত্র কারণে আমি সেখানে যেতে গেলেই কাজের মেয়েরা চিৎকার করে উঠতো, “খালাম্মাগো! ফাহিম আবার পিছনে যাইতাছে!”। সাধারনত মুরগী-জবাই ও কাপড়-মেলার কাজে সেই উঠানটি ব্যাবহৃত হত। সেখানে আমার কাজ ছিল টবে লাগানো আমগাছে পানি দেয়া, এবং দেয়ালে বসা মশা তাড়ানো। তবে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার আসল মজা ছিল – বাড়ির ভেতরে। বাড়িটি ছিল বেশ পুরাতন ও বিশাল। অল্প বৃষ্টি হলেই ভেতরে পানি ঢুকে যেত, এবং আমরা তুমুল আনন্দে সেই পানিতে দাঁপাদাঁপি করতাম। বাড়িটিতে মোট রুম সংখ্যা ছিল পাঁচ।কিন্তু রুমগুলো এতই বিশাল ছিল যে বাড়ির এক প্রান্ত থেকে ডাকা হলে অন্য প্রান্তের মানুষ শুনতে পেত না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই – আমার ছোট খালা তখন সবে মাত্র মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন – ডাক্তার হবেন। আমি পড়ি ক্লাস ফোরে। আমার পড়ার ঘর, আর ছোট খালার শোবার ঘর তখন পাশাপাশি। বাড়ির একেবারে কোণার রুম দু’টো আমাদের দু’জনকে দেয়া হয়েছে – যেন মেহমান আসলেও পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। আমরাও সেই সুযোগে লুফে নিয়ে তার পূর্ণ অপব্যাবহার করছি সাধ্যমত। মেহমান আসুক আর না আসুক, বড়দের চোখের অগোচরে থাকায় তখন আমাদের পড়ার বইয়ের নীচে থাকে গল্পের বই। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমার পড়ার ঘর আমি আর খালা মিলে ভরিয়ে ফেলেছি নানা রকম গল্পের বইয়ে। গল্পের বইগুলো মূলত প্রেম এবং ভূতের।
যাইহোক, ৮ থেকে ৯ বছর বয়স হল মানুষের ভূতে বিশ্বাস করার শ্রেষ্ঠ সময়। আমিও কেবল অল্প-সল্প ভূতে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। এমন সময় বাড়িতে আমদানি করা হল মানুষের কঙ্কাল! সেই কঙ্কালের খুলি আবার আলাদা করে যত্ন সহকারে সাজিয়ে রাখা হল খালার পড়ার টেবিলে। সেখানে বসে খুলি দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হাসতে লাগল দাঁত বের করে। এদিকে পাশের রুমে থাকি বলে আমার অবস্থা হল কেরাসিন!
আমাকে তখন পড়ার রুম থেকে অন্য রুমে যেতে হয় দৌঁড়ে। বাথরুম থেকে শুরু করে খাবার ঘর। টিভি রুম থেকে শুরু করে রান্নাঘর – সবখানে। অবস্থা এক সময় এতই করুণ হল যে রাতের বেলা কারেন্ট চলে গেলে মো্মবাতি আনতেও আমাকে যেতে হত দৌঁড়ে! এ দৌড়া-দৌড়ির কারণ খুবই সাধারন। মরা মানুষের নৈতিকতা বলে কিছু থাকার কথা নয়। কখন ধরে ক্যাক করে ঘাড় মটকে দেবে কেও জানে না। জীবন বাঁচানোর তাগিদেই মূলত আমার এই দৌড়া-দৌড়ি।
এরই মাঝে একদিন ভূতের গল্পের বই পড়তে গিয়ে আমি অনুভব করলাম শীতল এক শিহরণ। হঠাৎ কি হল কে জানে? আমি ওই খুলি্র সামনে দিয়ে দৌঁড়ে যেতেও ভয় পেতে লাগলাম! তখন বাজে দুপুর ১ টা। পাশের রুমে কেও নেই। খালা আসবে দুপুর ২ টায়। বাড়ির বাকি সদস্য – আমার নানু ও কাজের মেয়ে, সবাই রান্নাঘরে কাজ করছে। সমাধান একটাই, যত জোরে সম্ভব গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকি করা। কেও নিশ্চয়ই শুনে এগিয়ে আসবে। পাঠক বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি গলা ফাটিয়ে চেঁচানো্র পরও কেও আমার ডাক সেদিন শুনতে পায়নি। পরে আমাকে উদ্ধার করা হয় দুপুর ২ টায় – খালা আসার পরে!
কথায় কথায় অনেক দূর চলে এসেছি। আমি কথা খুব গুছিয়ে বলতে পারি না। কিছু একটা বলতে গেলে দুনিয়ার সব কথা মাথায় এসে জ্যাম করে ফেলে। যেই ঘটনাটি লেখার জন্য আজকে লিখতে বসেছি সেটাই এখনো শুরু করতে পারিনি! তাই আর কথা না বাড়িয়ে এখনই শুরু করছিঃ
তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। ক্লাস ওয়ানে পড়ি।
ছোট বেলায় অনেকের অনেক কিছু হবার স্বপ্ন থাকে। কেও হতে চায় পুলিশ, কেও ডাক্তার, কেও ব্যারিস্টার। কিন্তু আমার জীবনের ইচ্ছা ছিল একটু অন্য-রকম। আমি কেন যেন ‘কবি‘ হতে চেয়েছিলাম! তবে অনেক ভেবে আমি এর একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি।
অবসরে যাবার পর, আমার নানা প্রতিদিনই অনেকক্ষণ ধরে খবরের কাগজ পড়তেন। লেখালেখি সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা আমার খুব সম্ভব আসে সেখান থেকেই।
আমার ধারণা হয় লেখা-লিখি করেই বোধ হয় মানুষের সব থেকে কাছে যাওয়া যায়! অবশ্যই ছয় বছর বয়সে চিন্তাটা এত গুছিয়ে আমার মাথায় আসেনি! তবে হ্যাঁ – লেখা-লেখির একটি তারণা আমার মাঝে সব সময় কাজ করত। অনেকে আবার মনে করতে পারেন এটি ছিল আমার attention পাবার তীব্র-ইচ্ছার একটি বহিঃপ্রকাশ। হয়ত! হতেও পারে! যেটাই হোক, এমনই এক দূর্যোগপূর্ন সন্ধিক্ষণে আমি আবিস্কার করলাম – বসার ঘরের ফ্রেমে বাঁধানো বুড়ো মানুষটি আমার নানা’র বাবা নন, তিনি অনেক বড় একজন কবি! তখন ও জানতাম না যে ভদ্রলো্কের নাম রবি-ঠাকুর। তা এই সত্য জানবার পর আমার ধারনা হল – কবি হতে হলে প্রথমেই যে জিনিষটি আমার প্রয়োজন তা হল – দাঁড়ি। আমি তাই সেই বয়সেই উঠে-পড়ে লেগে গেলাম দাঁড়ি গজাতে! দাঁড়ির আশায় রোজ আমি গোছল করতে গিয়ে আব্বুর সেইভিং ক্রিম ও টুথব্রাশ দিয়ে গাল কামাই। রেজার ধরতাম না কারণ আমার নানাকে দেখেছি সেইভ করার সময় গাল কেটে ফেলতে। কিছুদিন পর আমি বারান্দায় বসে ধ্যানও করা শুরু করলাম। টিপু সুলতান দেখে ততদিনে আমি জেনে গেছি ধ্যান করলে পন্ডিত হওয়া যায়, আর পন্ডিত হলে লেখা যায় কবিতা।
তবে মজার ব্যাপার হল, আমার এই সব কাজে তুমুল উৎসাহ দিতে থাকলেন আমার নানা।
হঠাৎ হয়ত তিনি বারান্দায় গিয়ে দেখলেন আমি চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনে বসে আছি। তিনি আমাকে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করতেন, “কেমন যাচ্ছে ধ্যান?”
আমি এক চোখ খুলে আরো গম্ভীর হয়ে বলতাম, “এখনো কোন কবিতা মাথায় আসছে না।”
নানা উৎসাহ দিয়ে বলতেন, “চলে আসবে, পুরোটাই সাধনার বিষয়। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করো এক মনে। আমি আঙ্গুর দিয়ে যাচ্ছি। খেতে খেতে চিন্তা কর।”
আমি আঙ্গুর খেতে খেতে চিন্তা করতাম। কিন্তু কোন ভাবেই কোন লাভ হতো না।
এমনই একদিন আমি খুঁজে পেলাম আমার স্কুলের আগের বছরের একটি ম্যাগাজিন। সেখানের কিছু কবিতা বেশ ভাল লাগল। টিয়া পাখি সংক্রান্ত কবিতা। আমি সেটা টুকে নিয়ে নানাকে দেখালাম নিজে লিখেছি বলে। নানা আমার কবিতা দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। যেই আসে তাকেই দেখাতে লাগলেন – “আমার নাতির লেখা কবিতা। পড়ে দেখেন।” তার আনন্দ দেখে আমিও আনন্দ পেতাম। আরো জোড়ে-সোড়ে চলতে থাকল আমার কপিং এন্ড পেষ্টিং। কিন্তু সব গল্পেরই একটা শেষ আছে। সব দুর্নীতিরই শেষ পরিণতি – সত্যের জয়ের মধ্য দিয়ে। আমার কপিং-পেষ্টিংইয়েরও তাই শেষ হয়েছিল এক মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ঘটনাটা এরকমঃ
প্রায় ২ মাস টানা কবিতা কপিং-পেষ্টিং করার পর আমি তখন বাসার স্বীকৃত একজন উঠতি-কবি-প্রতিভা। কিন্তু রাজার-গোলার মত আমার কবিতা-কপি করার গোলাও ফুরিয়ে এসেছে ততদিনে। I need some new resource. বাধ্য্ হয়েই আমি বেছে নিলাম আমার পাঠ্যপুস্তককে। লিখে নিয়ে গেলাম আমার লেখা শেষ কপিং-কবিতা আমার নানার কাছে। নানা মৃদ্যু স্বরে পড়লেন –
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
নানা পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে কি বলেছিলেন ঠিক মনে নেই, তবে এরপর থেকে আমি আর কোন দিন গল্প বা কবিতা কপি-পেষ্ট করিনি। শিল্প এমন একটি বিষয়, যা কখনো কারো কাছ থেকে ছিঁনিয়ে নেয়া যায় না। একজন কবির মৃত্যু্র সাথে সাথে মৃত্যু হয় তার সৃষ্টির। একজন কবিই কেবল পারে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে তার প্রতিভা, চেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। এই সূক্ষ বিষয়টি আমি অনেক ছোট বেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম এ ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমার আজকের এই অবস্থানের জন্য আমার নানার অবদান তাই অনেক বেশি। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার আদর্শের কিছুটা হলেও আমাদের মাঝে যে তিঁনি দিয়ে যেতে পেরেছেন, এটাই তার স্বার্থকতা। আর এটাই আমার পুরুষ্কার, ও প্রাপ্তি।
Search terms: Fahim Aziz, Lekha Lekhi Suru Korar Kahini, Bengali short story, bangla story