অতি চালাকের গলায় দড়ি

আমার স্কুল-জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে। যারা এই স্কুলটির সাথে পরিচিত নয় তাদের জন্য বলছি – এই স্কুলটি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতরে, ব্রিটিশ-কাউন্সিলের ঠিক উল্টোপাশে অবস্হিত। হঠাৎ কেন যেন মনে হল আমার এই স্কুলটি নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। আমার স্কুল জীবনের কিছু মজাদার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তাই আজকের এই ধারাবাহিক আয়োজন।

ক্লাস ওয়ানে রোজি আপা ছিলেন আমাদের ইংরেজী শিক্ষিকা, এবং অতি ফর্সা একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন আমাদের শ্রেণী শিক্ষিকা।

ফর্সা আপার নাম এ মূহুর্তে মনে পড়ছে না।

শুধু মনে আছে, ম্যাডামের চুল ছিল কোকড়া, এবং তিনি বিশাল খয়েরী ফ্রেমের এক চশমা পড়তেন। শিশুদের সাথে ভদ্র মহিলা ছিলেন অত্যন্ত আমায়ীক। ক্লাসে আমরা কেও ভুল কিছু লিখলেও তিনি হাসতে হাসতে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। তাঁর কাছ থেকে আদর পাওয়ার লোভে আমরা তাই ইচ্ছে করেই ভুল-ভাল লিখে ক্লাসের খাতা জমা দিতাম। বাংলাদেশের পতাকার রং হলুদ, নীল লিখেও এককালে আমি তাঁর কাছ থেকে আদর বাগিয়ে নিয়েছি।

আমার আজকের ঘটনা এই দুই মহান শিক্ষিকাকে নিয়ে।।

যখনকার কথা বলছি, উদয়নের নতুন বিল্ডিংয়ে আমরা সবে মাত্র পা রেখেছি।

সবকিছুই নতুন।

নতুন ব্ল্যাক বোর্ড, নতুন ডেস্ক, নতুন চেয়ার!

আমাদের ক্লাসের দেয়ালের রং-ও তখন নতুন। সেই দেয়ালে প্যান্ট ঘষা লাগলেই চুন লেগে সব সাদা হয়ে যায়।

অন্যরকম একটা অনুভূতি!

এমনই এক অবস্থায় আমাদের প্রথম ক্লাস শুরু হলো উদয়নের লেফ্ট উইংয়ের দো’তলায়।

জানলা দিয়ে তাকালেই তখন আমরা দেখতে পাই তেঁতুল গাছের বিকট কান্ড, আর ক্লাস থেকে বের হয়ে ডানে ঘুরলেই পড়ে তেতুল গাছের সাথে লাগোয়া গোল বারান্দা।

প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে দেখি আমার কেজি ১-এর প্রিয় বন্ধু ইমরান হুসাইন হাসি মুখে ক্লাসে সামনের বেঞ্চে বসে আছে।

তাঁকে দেখে আমিও আনন্দে আটখানা!

দিনের শেষে সেই আনন্দ আরো দশগুন বেড়ে গেল যখন জানলাম, আমার বন্ধু ক্লাস ক্যাপ্টেন হতে চলেছে! ক্লাসে তাঁর রোল নম্বর ‘এক’!

তবে সমস্যা দেখা দিল অন্যখানে।

সে আমলে শিশু মহলে চলছিল টিপু সুলতান ক্রেজ।

সব গ্যাদার বেল্টের চিপায় তখন টিপু সুলতানের তরবারীর মত কাঠের স্কেল গোঁজা।

যখন তখন সেই স্কেল বের করে ঘোরাতে ঘোরাতে আমরা যাঁর-তাঁর ওপর ঝাপিয়ে পড়ি।

ঝাপিয়ে পড়ার আগে আবার “আক্রমণণণ” বলে বিকট এক চিৎকার দেই!

“ক্যাপ্টেন” শব্দটি তাই আমাদের ভাব-আবেগে নাচন তুলল একটু অন্যভাবে।

আমরা ধরে নিলাম আমার এই বন্ধু এখন থেকে ক্লাসের রাজা, আর আমরা তাঁর সিপাহী (লাঠিয়াল বাহিনী)!

যারা আমার বন্ধুর কথা শুনবে না , তাদের পিটিয়ে মানুষ করাই আমাদের মূল কাজ!

এরই মাঝে শিশুমহলে ছড়িয়ে পড়ল বেশ কিছু গুজব –

গুজব ১ – ক্লাস ক্যাপ্টেনের অনেক ক্ষমতা। সে শুধু একবার মুখ ফুটে বললেই হলো। বড় আপা সাথে সাথে স্কুল বন্ধ করে দেবেন।

গুজব ২- উদয়নের ৫ তালাতে একটি সুইমিংপুল তৈরি হচ্ছে। ছুটির পর সেখানে ক্লাস ক্যাপ্টেনরা বড় আপার সাথে খেলাধূলা করবে (আমরা যখন নতুন বিল্ডিংয়ে ক্লাস শুরু করি ৫ তালার নির্মান কাজ তখনও চলছে)।

এই যখন পরিস্থিতি, হঠাৎ একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি, আমার বন্ধু ইমরান হুসাইন আর রোল নম্বর দুই – ইমরান খান পাশাপাশি বসে আছে!

ঘটনা কি জানতে চাইলে আমাকে জানানো হলো, রোল নম্বর এক এবং রোল নম্বর দুইয়ের একসাথে বসা উচিত। কারণ তাঁরা দু’জনেই ভাল ছাত্র। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজ থেকে তাঁরা দুজনেই মিলেমিশে ক্লাস শাসন করবে! আমাদের পেটোয়া বাহিনীর প্রটেকশানের তাদের আর দরকার নেই! এখন থেকে তাদের প্রোটেকশান দেবে খাতা, কলম আর বড় আপা নিজে! (বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন তাঁরা গ্যাদা বয়সেই আসল ক্ষমতার খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল)।

ব্যাপারটাতে আমি দুঃখ পেলেও করার কিছু ছিল না। বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমি নতুন বন্ধু খুজে নিলাম।

তাঁর নাম ছিল সাজিদ মুহাইমিন চৌধুরী।

সাজিদ ছিল সদ্য বিদেশ ফেরত – বেশ লম্বা, মোটাসোটা, এবং ফর্সা।

সারাদিন সে হলুদ দাঁত বের করে হাসতো, এবং কোন এক বিচিত্র কারণে, সে হাসলেই আমি তাঁর মুখ থেকে মুরগীর হাড্ডির গন্ধ পেতাম।

এই ছেলেটির সাথে ক্লাস ওয়ানে আমার দুটি বিচিত্র ঘটনা ঘটে।

ঘটনাগুলো নিম্নরুপঃ

ঘটনা ১

সাজিদের সাথে বসতে শুরু করার কিছুদিন পরই আমি উপলব্ধি করলাম এই ছেলে সাইন্স ফিকশানের অন্ধ ভক্ত।

একদিন তাঁকে ‘কাওকে না বলার’ শর্তস্বাপেক্ষে বললাম, “জানিস, আমার বাসায় একটা রবোট আছে। সেটা সাধারণ মানুষের মতই হাঁটা-চলা করে, কথা বলতে পারে”।

আমার কাছে থেকে এমন আজগুবি কথা শুনে সাজিদ বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকল।

এরপর যখন আমি ধরে নিয়েছি ছেলে আমার ফাজলামি ধরে ফেলেছে, সাজিদ আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“ রবোটটা কি ছেলে নাকি মেয়ে? কথা বাংলাতে বলে নাকি ইংরেজীতে? নাম কি?”

তাঁর বড় বড় চোখের চাহুনীতে আমি পুলকিত হলাম। শুরু হলো একের পর এক কিচ্ছা-কাহিনী। উদাহরণ নিম্নরুপঃ

আমিঃ বুঝলি সাজিদ, আমার রবোটের তো মা-বাবাও আছে।

সাজিদঃ বলিস কি! মা-বাবা’র সাইজ কতটুকু?

আমিঃ বাবা তিন তালার সমান, মা দুই তালা, আর আমার বাচ্চা রবোটটা হাঁটুর সমান।

সাজিদঃ (অবিশ্বাসের ভাব করে) যাহ! মিথ্যা কথা!

আমিঃ হুম (হ্যা এবং না-এর মাঝামঝি একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে)

সাজিদঃ আমার সাথে ফোনে কথা বলাতে পারবি?

আমিঃ অবশ্যই!

এরপর একদিন সাজিদ ফোন করে।। আমিও গলা বিকৃ্ত করে তাঁকে বলি –

আমিঃ চিয়্যায়ু চ্যি চ্যিইয়া কে ঠুমি?

সাজিদঃ আমি সাজিদ। আপনি কেমন আছেন?

রোবটঃ চিয়্যায়ু চ্যি, ভালু। চ্যিচ্যি চ্যিইয়া তুমি কিমন চিয়ায়ু আছেই?

আর এভাবেই কখন যেন আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম!

এবার আসি ঘটনা ২-এ।

ঘটনার দিন আমাদের ষান্মাসিক পরীক্ষা চলছে।

আমার আর সাজিদের তখন বেশ একটা মাখামাখি অবস্থা।

ইমরান নামের যে আমার কোন কালে কোন বন্ধু ছিল – সেটাই আমার আর তখন মনে নেই। আমি বেশ আছি সাজিদের সাথে।

যাইহোক, হলে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি।

আমি আর সাজিদ পাশাপাশি বসেছি।

দুজনেই পরম আনন্দে লিখে চলেছি। আমরা দু’জনেই তখন বেশ ভাল ছাত্র!

আমাদের পেছনে বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে আমার কেজি-১ গল্পের ব্যাগওয়ালী!

হঠাৎ পরীক্ষা দেবার মাঝে পেছন থেকে ব্যাগওয়ালীর পেন্সিলের খোঁচা।

আমি বিরক্ত হয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল – “তুই আমাকে গালি দিয়েছিস বলে আমার দাদী মারা গেছে”।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল! পরীক্ষার চিন্তা তখন জানলা দিয়ে পালিয়েছে।

আমি অবাক হয়ে পেছনে ঘুরে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলাম।

পরীক্ষা দেয়ার থেকে এই ঘটনা বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হওয়াতে সাজিদও লেখা থামিয়ে আমার সাথে পেছনের দিকে ঘুরে গেল।

আর এর সাথে সাথেই আমি এবং সাজিদ অনুভব করলাম আমাদের পরীক্ষার খাতায় মৃদ্রু টান।

পরীক্ষার হলে কথা বলার দায়ে ফর্সা আপা ৫ নম্বর খ্যাচ করে কেটে দিলেন আমার এবং সাজিদের খাতা থেকে!

এই ঘটনা দেখে ব্যাগওয়ালীকে দেখা গেল খিলখিল করে হাসতে।

আপা একটু দূরে যাবার পর পেছন থেকে শোনা গেল – আমার সাথে ক্লাসে কথা বলিসনি যে, তাই মার্ক কাটিয়ে দিলাম! এখন বুঝ মজা! হিঃহিঃহিঃ!

ঘটনার এই মারপ্যাচে আমি মর্মাহত হলেও, সাজিদকে দেখলাম বেশ খেপে গেছে। যতদূর মনে পড়ে কোন রকম উসকানি ছাড়াই একটু পর সাজিদ চেঁচিয়ে উঠেছিল- আপা! এই মেয়ে (ব্যাগওয়ালী) আমার সাথে কথা বলে! আমাকে লেখতে দেয় না!

পরিণাম – ফর্সা আপা ছুটে এসে ব্যাগওয়ালী-র খাতা থেকেও কেটে নিলেন ৫ মার্ক!

এখন আসি রোজি আপার গল্পে।।

আগেই বলেছি ক্লাস ওয়ানে থাকতে আমি ছিলাম উদয়নের দুর্দান্ত ছাত্রদের একজন।

তবে আমার এই “দুর্দান্ত ছাত্র” তকমার পেছনে একটি ভয়াল রহস্য ছিল।

রহস্যটা হলো, আমার বড় কাজিনও সে সময় উদয়নে পড়ত (উপরের ক্লাসে), এবং বছরের শুরুতেই তাঁর ক্লাস নোটের খাতা থাকত আমার টেবিলে। একারণে আগের বছরের ক্লাস নোট দেখে আমি আগে থেকেই জানতাম আজকে ক্লাসে কি পড়ানো হবে! সেটা আমি তাই আগে আগে বাড়ি থেকে শিখে আসতাম এবং পরে চোখ বন্ধ করে ক্লাসে উগড়ে দিতাম।

এই যখন পরিস্থিতি, একদিন রোজী আপার ক্লাস চলছে।

ক্লাসে তিনি শিখাচ্ছেন ১০টি ইংরেজী পাখির নাম।

এক এক করে তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছেন সব গুলো পাখির নাম। আমাদের কাজ হলো সেগুলো ক্লাসের খাতায় সুন্দর করে টুকে ম্যাডামকে দেখানো।

আমি যেহেতু আগে থেকেই এই সব পাখির নাম জানি, আমি তাই আর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আর সময় নষ্ট করলাম না।

নিজের স্মৃতি থেকে দশটা পাখির নাম লিখে জমা দিলাম রোজী আপার কাছে।

এক সময় খাতা ফেরত পেলাম, এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার খাতা আপার লাল কালি দিয়ে ভরা! খাতার ওপরে বড় করে লেখা “আবার লিখে জমা দাও”।

আমি অবাক হয়ে বোর্ডের সাথে আমার পাখির নাম মিলিয়ে দেখলাম এবং বিড়বিড় করে বললাম – “হুম। ঠিকই তো আছে! প্যারোট – প্যারোট, ক্রো – ক্রো। ভুলটা কোথায়?”

মূলত, সে সময় আমি বুঝতে পারছিলাম না, আপার ১ নম্বর পাখির নাম আমি লিখেছি ৫ এ। আর ৫ নম্বরেরটা ১০-এ – এতেই আপার আপত্তি।

আমি তাই আবারও একই নাম লিখে আপাকে জমা দিলাম, এবং আপা অবাক হয়ে দেখলেন আমি একই ভুল আবার করেছি।

এবার ১ নম্বর পাখির নাম ৩ নম্বরে, আর ৩ নম্বরেরটা ৭ নম্বরে!

আপা তাই বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন – আজকে তুমি এটা ঠিক মত না লিখে বাড়ি যাবা না। আবার লিখো!

ঘটনার এ পর্যায়ে ছুটির ঘন্টা পড়েছে।

আমার নানু নীচের খোলা মাঠে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

এক সময় খোলা মাঠ খালি হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর নাতী এখনও আসছে না। তাঁর চোখে ফেটে কান্না আসছে। বুঝতে পারছেন না কার কাছে যাবেন খোজ নিতে।

মনে তখন সংশয় ভর করেছে – নাতীকে কি ছেলেধরা ধরে নিয়ে গেল?

তিনি স্কুলময় ছুটোছুটি শুরু করলেন, এবং এক সময় দারোয়ান চাচাকে অনুরোধ করলেন আমাকে একটু খুজে দেখার জন্য।

দারোয়ান চাচা যখন আমাকে খুজে পেলেন আমি তখন বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে উল্টো-পাল্টা অর্ডারে পাখির নাম লিখছি।

ইতিমধ্যে আমি ৬ বার পাখির নাম লিখে ফেলেছি।

আমার পেছনে রোজি আপা এবং ফর্সা আপা চিন্তিত মুখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।

দারোয়ান চাচা “আমার নানী আমাকে খুঁজছেন” জানাবার পর আপারা নানীকে ক্লাসে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করলেন।

ক্লাসে আসার পর নানুকে আপারা কি বলেছিলেন আমার মনে নেই। তবে সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম, ব্ল্যাকবোর্ডে শিক্ষিকা যে অর্ডারে লিখেন, সেভাবেই খাতায় জিনিষপত্র টুকে আনতে হয়, এবং অতি চালাকের সব সময়ই গলায় দড়ি জোটে।।

বিদ্রঃ ইমরান খানের সাথে পরবর্তীতে আমার এক কাজিনের বিয়ে হয়। গ্যাদা কালে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে চুরি করার দায় থেকে তাই তাঁকে মুক্তি দেয়া গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *