আমার স্কুল-জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে। যারা এই স্কুলটির সাথে পরিচিত নয় তাদের জন্য বলছি – এই স্কুলটি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতরে, ব্রিটিশ-কাউন্সিলের ঠিক উল্টোপাশে অবস্হিত। হঠাৎ কেন যেন মনে হল আমার এই স্কুলটি নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। আমার স্কুল জীবনের কিছু মজাদার ও তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই তাই আজকের এই ধারাবাহিক আয়োজন।
আমি যখন উদয়নে ভর্তি হই, এই স্কুলের চেহারা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন।
এরশাদ সাহেব তখনও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। আর ঢাকার রাস্তায় গাড়ি বলতে আমরা বুঝি টয়োটা ১৯৮৬ ও রিকশা!
আমাদের বাসা ছিল আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারের। সেখান থেকে রিকশায় উদয়নে যেতে লাগত বড়জোড় দশ মিনিট। বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকে গেলেই ছিল এক বিশাল রাস্তা। সেই রাস্তার বাম পাশে ছিল ইউনিভার্সিটির মাঠ, আর ডান দিকে দেয়াল ঘেরা পার্ক। রাস্তার মাঝখান দিয়ে যখন রিকশা এগিয়ে যেত, আমার নানা আমাকে জড়িয়ে ধরে গান ধরতেন, ‘আমি মরে গেলে পাশানের বুকে লেখোনা আমার নাম’। সকাল সাতটার মিঠা রোদে গানটা শুনতে প্রথম দিকে খুব একটা খারাপ লাগত না। কিন্তু পরে যখন লজ্জা-শরম হল, মানুষ “কি ভাবে” বোধটা নিজের মাঝে মাথা-চাড়া দিয়ে উঠল, তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে নানাকে আস্তে করে চুপ করতে বলতাম। পাছে কেও দেখে না হাসে! তবে তিনি তেমন একটা কেয়ার করতেন বলে মনে হয় না। আমার কথা শুনে উল্টো আরও উচ্চস্বরে গান গাওয়া শুরু করতেন।
তবে গানটির খুব সম্ভবত এই একটি কলি-ই তাঁর জানা ছিল। এর বেশি তিনি যেমন কোন দিন গাইবার চেষ্টা করেননি, আমিও কোন দিন জানবার আগ্রহ প্রকাশ করিনি (অন্তত আজকের আগে)!
লেখার এই মূহুর্তে আমার নানা-কে নিয়ে মজার একটা ঘটনা পড়ছে।
ঘটনা নিম্নরুপঃ
আমার নানা মনের দিক থেকে যতটা সাদা ছিলেন – গাঁয়ের দিক থেকে ছিলেন ঠিক ততটাই কালো। নানা কি পরিমাণের কালো ছিলেন সেই ব্যাপারটা একটু খুলে বলি।
নানা’র সবে মাত্র ডায়াবেটিক্স ধরা পড়েছে।
সে আমলে সুচের আগায় এক ফোটা ব্লাড নিয়েই সুগার মাপা যেত না। সুগার মাপার জন্য ব্যাবহার করা হত ৪ থেকে ৫ টা টেস্টটিউব। প্রতিটি টেস্টটিউবে রোগীর মুত্র ভরে, তা বিশেষ এক ক্যামিকেলের সাথে মিশিয়ে আগুনে গরম করা হত। এরপর ব্লাড সুগারের লেভেল বোঝা যেত টেস্টটিউবের ভেতরের সলিউশনটার রং দেখে।
আমি আর আমার ছোট খালা মিতু তখন পুরো ব্যাপারটাতেই চরম আহাল্লাদিত।
একটু পরপর নানা’র কাছে আমাকে পাঠানো হচ্ছে পেসাব নিয়ে আসতে।
নানা সিগারেট খাচ্ছে – পেসাব করো।
পেপার পড়ছে – পেসাব করো।
নামাজ পড়ছে – পেসাব করো।
নানা পুরো ব্যাপারটাতেই ত্যাক্তবিরক্ত!
কিন্তু কিছু করার নেই।
ডাক্তার বলে দিয়েছেন নানাকে কড়া অবজারভেশনে রাখতে হবে। অবজারভেশনের উপায় একটাই – ঘন্টায়-ঘন্টায় ব্লাড সুগার মাপা।
ডায়াবেটিক্স তখন ১১-১২ তে উঠানামা করছে। যত উপরে যাচ্ছে, নানা’র মুখ ততই কালো হচ্ছে – আর আমাদের হাসি তত বড় হচ্ছে। কারণ – সুগার লেভেল যত উপরে যাবে, আমরা তত বেশি টেস্টটিউব-টেস্টটিউব খেলতে পারব।
এমনই যখন পরিস্থিতি, হঠাৎ নানাকে জানানো হল – এক্সারসাইজ করলে নাকি ডায়াবেটিক্স কমে।
কাওকে কিছু না বলে নানা তাই ঠিক করলেন সকালে নামাজ পড়ার আগে উঠে ব্যায়াম করবেন।
ভোর তখন ৪ টা।
ঢাকা শহরের কাক গুলোও তখন ঘুমিয়ে আছে।
এমন সময় আমার মা’য়ের বিকট চিৎকার!
“ভূভূভূত ত ত ত ত!”
ঘুম থেকে উঠে সবাই এক দৌড়ে বৈঠকখানায়।
পরসমাচার এই যে, গভীর রাতে নানা উঠেছিলেন ব্যায়াম করতে আর আমার মা উঠেছিলেন পানি খেতে। পানির গ্লাস হাতে ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন এক ছায়ামূর্তী লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে।
ভোরের আধো আলোতে নানা’র চেহারা দেখা যাচ্ছিল না বলেই এই বিপত্তি। নানার গায়ের কালো আর ঘরের কালো মিলেমিশে একাকার!
যাইহোক, কথায় কথায় অনেক দূরে সরে গেছি, আমার মূল বক্তব্যে ফিরে যাই। যখনকার কথা বলছিলাম, তখন উদয়ন ছিল একটি বিশাল টিনের ঘর! সেই টিনের ঘরের সামনে ছিল একটি বিশাল মাঠ। আর মাঠের পাশ দিয়ে একটি স্লিপার। একবার খেলার পিরিয়ডে আমি সেই স্লিপারে উঠে আটকা পড়ি। সিড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে গেলেও কোন এক বিচিত্র কারণে আমি স্লাইড করে নেমে আসতে পারছিলাম না। স্লিপারের মাথায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে কাঁদছিলাম। আমাদের খেলার শিক্ষক ওয়াহিদ স্যার (যাকে কোন বিচিত্র কারণে সবাই গেন্দু বলে ডাকত), তখন আমাকে উদ্ধার করেন। মূলত তিনি আমাকে স্লিপার থেকে ঝাঁপ দিতে বলেন তার কোলে। উচ্চতায় খাটো হওয়ায় তার পক্ষে আমাকে কোলে করে নামানো সম্ভব হচ্ছিল না।
তবে এই মূহুর্তে আবারো ফিরে যাচ্ছি আমার স্কুলের প্রথম দিনের বর্ণনায়।
ইতিমধ্যে আমি পরীক্ষা দিয়ে উদয়নে ভর্তি হয়েছি। খালাতো-বড় ভাই অন্তুকে স্কুলে যেতে দেখে, আমিও নাকি আমার পরিবারের ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করেছিলাম স্কুলে ভর্তি হবার জন্য (আমার মায়ের ভাষ্য মতে)। যেকারণে আমাকে এক বছর আগেই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। যতদূর মনে আছে, অবিভাবকদের তখন স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতর ঢুকতে দেয়া হত না। গেটের সামনে ঝুলানো থাকত একটি চিকন চেইন। সেই চেইন থেকে শুরু করে ক্লাস পর্যন্ত আমাদের একা একা হেটে ক্লাসে যেতে হত। যেসব বাচ্চা বাঁদর টাইপ, তাদের গেট থেকে বুয়ারা হাতে ধরে নিয়ে যেতেন। আমি বাঁদর টাইপ ছিলাম না। আমি ছিলাম শান্ত-শিষ্ট গরু টাইপের বাচ্চা। আমি প্রথমদিন স্কুলে গিয়েছিলাম আমার নানুর সাথে, আর ক্লাসে গিয়েছিলাম একা একা হেঁটে। আমার নানু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কোন অনভিপ্রেত কান্নাকাটি জন্য। তবে, আমার মায়ের ভাষ্য মতে আমি অন্তত লক্ষী ছেলের মতই ক্লাসে গিয়ে বসতাম, এবং কোন কিছু না লিখে বাড়ি ফিরে আসতাম! সেটা নিয়ে আমার টিচারদের ছিল অফুরন্ত অভিযোগ। মূলত যেসব বিষয় শেখার জন্য আমাকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল, আমার শিক্ষকরা সেগুলো্কে বাড়ি থেকে শিখে আসার বিষয় বলে অভিহিত করেন। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার ‘ অব্যাবস্থাপনা ‘ তাই খুব ছোটবেলা থেকেই আমি হাড়ে-হাড়ে টের পেতে শুরু করি। তবে এই ব্যাপারগুলো অন্যদের মতই আমাকে, বা আমার অবিভাবকদের কোন-দিনই কোন পিড়া দেয়নি। আর দশটা ছেলে-মেয়ে, বা তাদের পরিবারের মতই আমরাও ধরে নিয়েছিলাম – ‘এটাই স্বাভাবিক’, আর এর মাঝে থেকেই আমাকে বড় হতে হবে সবার সাথে মিলেমিশে।
কে জানে? বিদেশে পড়ালেখার সুযোগ না পেলে হয়ত এই উপলব্ধিটা কোনদিন আসতই না এ জীবনে!
যাইহোক, একটা বিশেষ ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে এক মূহুর্তে। সেটা নিয়েই কিছু একটা লিখতে চাচ্ছি। ঘটনাটি আমার স্কুল জীবনের প্রথম দিনের বলেই আমার বিশ্বাস।
সে সময় উদয়নের টিনের ঘরের পাশ দিয়ে ছিল এক লম্বা করিডর। এই করিডরের পাশ ধরেই ছিল সারি-সারি ছোটদের ক্লাস রুম। করিডরটির শেষ মাথা গিয়ে মিশেছিলো একটি পাঁকা দো’তালা বিল্ডিংয়ের সাথে। যেখানে খুব সম্ভবত বড়দের ক্লাস নেয়া হত। আমি ছোট হওয়ায় আমার ক্লাস ছিল করিডরের ঠিক মাঝখানে। গেটের দড়ি থেকে সেখানে আমার হেটে যেতে প্রায় লাগত প্রায় পাচ মিনিট। প্রথম দিন যখন একা একা হেটে যাচ্ছি, হঠাৎ-ই ঘটল একটা অঘটন। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার জুতার ফিতা খুলে গেছে। এর আগে আমি কোনদিন এ জাতীয় পরিস্হি্তির মুখোমুখি হইনি। সাধারণত আমি তখনো খালি পায়ে ঘুরে বেড়াই। জুতার ফিতা খুলে গেলে আশেপাশের বড় কাওকে বলতাম বেঁধে দিতে। তারা তাদের হাতের সব কাজ ফেলে হলেও আমার জুতার ফিতা বেঁধে দিতেন। তাই আমার ধারণা হয়েছিল জুতার ফিতা বাঁধা বোধ হয় শিশুদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়। আমার তাই চোঁখ ফেটে কান্না আসতে লাগল। মনে মনে বললাম। “হে মাটি তুই ফাক হ! আমি তো্র মাঝে ডুবে যাই”। কিন্তু ডুকরে কেদে ওঠার আগে মূহুর্তে এক বুয়া আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি মানি, হারায় গেছ? কেলাস কৈ তুমার?’ আমি কিছু বললাম না। শুধু ছলছল চোখে আঙ্গুল দিয়ে পায়ের দিকে দেখালাম। আমার খোলা জুতার ফিতা মাটিতে পড়ে আছে। বুয়া সমস্যাটা বুঝলেন বলেই মনে হল। পরম যত্নে উবু হয়ে বসে তিনি তা বেঁধে দিলেন। আর আমার মুখে হাসি ফুটল।
ঘটনার গুরুত্ব বিচারে হয়ত এটা কিছুই না। কিন্তু একজন শিশুর মনে দাগ কাটতে বাধ্য। না হলে আজ এত বছর পরও নিশ্চয়ই তা আমার মনে থাকার কথা নয়। মা-বাবা, নানা-নানু’র মত আপনজনদের দূরে রেখে, একটি শিশু যখন একা পথ চলতে শুরু করে, এই ক্ষুদ্র নিঃসার্থ মমতাই হয়ত তার কাছে বড় হয়ে ধরা দেয়। কে জানে! এই ছোট ঘটনাটি আমার জীবনে না ঘটলে হয়ত উদয়নকে পরবর্তীতে এতটা আপন করে নিতে পারতাম না। হয়ত মনে হত, সেখানে গেলেই তো খালি টিচাররা অকারণে অভিযোগ করেন। মমতার কোন মূল্য তো সেখানে নেই। তাহলে কেন যাব সেখানে? এই ঘটনা যেন সেই বিশ্বাসের মুখেই ছিল কালিমার প্রলেপ। এই ঘটনাই আমাকে শিখিয়েছিল সবাইকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতে।
fahim aziz, Udayan, short story, udayan uccho maddhomik biddaloy