৬ জুন ২০২৫
সকাল ১১:৪৫
আমার নাম টুকুন। বাবা আমাকে এই ঈদে একটা ডায়েরিটা কিনে দিয়েছে। বাবা বলেছে প্রতিদিন আমি কি করি তা এখানে সুন্দর করে লিখে রাখতে। একদিন বড় হয়ে আমি সবাইকে এগুলো পড়ে শুনাবো। আমি এর আগে কখনো ডায়েরি লিখিনি। আজকে লিখতে বসেছি। বিষয় – নানা-বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তায় কি-কি দেখলাম সেটা।
আমার নানাবাড়ি চিটাগাং। এবারের কোরবানি ঈদ আমরা চিটাগাংয়ে করেছি। এই মূহুর্তে আমি বসে আছি আন্তঃনগর ট্রেনে। আমার বাবা ঢাকায় কাজ করেন বলে আমরা সেখানেই থাকি। এখন আমার বাম-পাশে বসে আছে মা, আর সামনের সিটে বাবা। বাবা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর মা সেলাই করছে। আমাদের ট্রেন একটু আগে কুমিল্লা ছাড়িয়েছে। আর আমি কোলের ওপর ডায়েরি রেখে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু কি লিখব ঠিক বুঝতে পারছি না। ট্রেনের জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ আগেও উঁচু উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। এখন শুধু সবুজ মাঠ আর কাঁচা বাড়ি-ঘর। সে-সব মাঠে গরু ঘাস খাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা খেলছে। আমার মনটা খুব খারাপ লাগছে নানাভাইয়ের জন্য। ইচ্ছে করছে আমার নানাবাড়ি ফিরে যাই।
রাত ১০:০০, ঢাকা
লিখতে ভাল লাগছিল না বলে ডায়েরিটা সরিয়ে রেখেছিলাম। এখন আবার ভাত খেয়ে লিখতে বসেছি।
আমরা বাড়ি ফিরেছি সন্ধা ৬ টায়। সকাল থেকে আবার স্কুল। তাই খুব তাড়াতাড়ি ডায়েরিটা লিখে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ডায়েরিটা লিখছি কারণ – বাড়ি ফেরার পথে একটা মজার ঘটনা ঘটে গেছে!
আমাদের ট্রেন তখন মাত্র ভৈরব পার হয়েছে। লাইনে কাজ হচ্ছে বলে কিছুক্ষণের জন্য ট্রেনটা মাঠের পাশে থামিয়েছে। হঠাৎ দেখি ‘লালি’র মত দেখতে বিশাল এক গরু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে জাবর কাটছে।
‘লালি’ আমার নানা-বাড়ির পোষা গরু। বয়স হয়ে গিয়েছিল বলে এবার ‘লালিকে’ নানাভাই কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দিতে পারেননি, কারণ আমি কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুলেছিলাম। ‘লালি’-কে বাঁচিয়েছি বলে লালি আমাকে ‘হাব্বা-হাব্বা’ করে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘লালি, খুশি হইয়েছেন?’।সে মাথা ও লেজ নাড়িয়ে বলেছে, ‘হ্যাঁ, খুব খুশি!’। আমি লালিকে আপনি করে বলি, কারণ সে আমার বয়সে বড়।
তবে এবার নানা-বাড়ি আসার আগে আমি লালিকে বিদায় বলে আসতে পারিনি। ঈদের দিন মামার সাথে আমি একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম দুপুরের দিকে। এসে দেখি লালিকে নানাভাই দারোয়ান-কাকার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘লালি’-র সামনে অন্য গরুদের কোরবানি দেয়া হলে লালি ভয় পেতে পারে, সেজন্য। ঈদের পর আমরা আরও ৩ দিন নানা-বাড়ি ছিলাম। কিন্তু লালি’র সাথে দেখে হয়নি। নানাভাই বলেছিলেন তাকে আরও কিছুদিন দারোয়ান-কাকার বাড়ি রাখা হবে। কুরবানি দেয়া গরুর রক্ত মাটিতে শুকিয়ে যাবার আগে ঘরে আনলে নাকি রোগ-বালাই হতে পারে।
যাইহোক, মাঠের পাশে যে গরুটি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল, সেই গরুটির গায়ের রংও ছিল লালি’র মতই লালচে-বাদামী। তবে তার কানে একটি দুল ঝুলছিল। মাথার উপর বেশ কয়েকটি মাছি ভন-ভন করছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, বেশ কিছুদিন হয় তাকে কেও গোসল করায়নি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়েছিলাম। গরু গৃহপালিত প্রাণি। মানুষের সাথে থাকতে থাকতে তারাও মানুষের মত আদব-কায়দা শিখে ফেলে। বাড়িতে মেহমান আসলে এজন্যই তাদের দেখা যায় ‘হাব্বা-হাব্বা’ করে ডাকা-ডাকি করছে। আমার ধারণা ‘হাব্বা-হাব্বা’ করে তারা মানুষকে ‘সালাম’ দিতে চায়, কুশোলাদি বিনিময় করতে চায়। যেসব গরু বেশি বয়স্ক, তারা ‘হাব্বা-হাব্বা’ করে বেশি। কারণ – তারা বলতে চায়, “এই যে মুরুব্বি, আপনি কি জানেন আপনার জন্মের আগে থেকেই আমি এই গোয়ালে থাকি? আপনার নানা-দাদা’র-ও বন্ধু ছিলাম আমি। আমাকে সালাম না দিয়ে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? হুমম?”
সে কথা চিন্তা করে আমি তাই শুরুতেই গরুটাকে একটা বড় দেখে সালাম দিলাম।
আমি বয়সে অনেক ছোট। ক্লাস টু’তে পড়ি। এই গরুটি অবশ্যই বয়সে আমার থেকে বড় হবে।
কিন্তু সে আমার সালামের কোন উত্তরে দিল না। মাথাও নাড়ালো না। শুধু জাবর কাটার পরিমানটা যেন একটু বাড়িয়ে দিল!
শুরুতে আমি খুব রাগ করেছিলাম।
শিশুরা সালাম দিলে বড়দের কর্তব্য সেই সালামের উত্তর দেয়া। আমার খালা আমাকে বলেছেন, শিশুদের স্থান ফেরেশ্তাদের কাছাকাছি। ফেরেশ্তাদের মতই তারাও নিস্পাপ। তারা যাই করুক না কেন – ‘সরি’ বললেই সব কিছু মাফ হয়ে যায়। যেসব শিশু খুব বেশি ছোট, কথা বলতে পারে না – তাদের মাফ পাওয়া আরো সহজ। কোন একটা পঁচা কাজ করেই তাদের কাজ হচ্ছে ‘কু-কু’ করে কাঁদা। তবে এমন ভাবে কাঁদতে হবে যেন সবাই মনে করে – সব দোষ তার পাশে থাকা বড়-মানুষটির। তাহলেই সব কিছু মাফ।
উদাহরণ-স্বরূপ বলা যেতে পারে – অপরিচিত মেহমানের বাসায় গিয়ে, কারো নতুন শাড়িতে ‘পেসাব’ করে দেয়া। শিশুরা সাধারণত এই কাজটি খুবই সচরাচর করে থাকে। বড়রা জানে না, কিন্তু এই কাজটি তারা আসলে বুঝে-শুনেই মজা পাবার জন্য করে। এজন্যই দেখা যায়, যেসব শিশু একবার কারো শাড়িতে পেসাব করে – সে বারবার কাজটি করতেই থাকে। কারো কোলে দেবার আগেই মা-বাবা’কে বলতে হয়, ভাবি দেখবেন ও কিন্তু পেসাব করে দিতে পারে। ভাবিরা সাধারণত কোলে নিয়ে একটি চান্স নেন, কিন্তু প্রতিবারই সেই বাচ্চারা তাদের কো্লে পেসাব করে দেয়! শুধু তাই না, পেসাব করে তারা এমন ভাবে কান্নাকাটি শুরু করে যে সবাই মনে করে ওই মেহমান-ই বোধ হয় তাকে ভয় দেখিয়ে পেসাব করিয়েছে! মোট কথা, ভুল বা বেয়াদপি শিশুরা করতেই পারে। কিন্তু শিশুদের সাথে বড়দের বেয়াদপি কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যাইহোক, আমি ছোট-মানুষ হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন ছেলে। গরুটা আমার সালামের উত্তর না দিয়ে কেন তাড়াতাড়ি খাচ্ছে, আমি খুব সহজেই বের করে ফেললাম। বাবা বলেছিলেন, ‘খাবার সময় মুসলমানদের কথা বলা নিষেধ। খাওয়া হচ্ছে ইবাদতের একটি অংশ’। গরুটা নিশ্চয়ই মুসলমান! তাই সে খাওয়া শেষ করার আগে সালাম দিতে পারছে না। আমার ধারনা ছিল খাওয়া শেষ করেই সে ‘হাব্বা’ বলে আমার সালামের উত্তর দেবে।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম তার খাওয়া শেষ হবার জন্য, আর চিন্তা করতে লাগলাম – শিশুদের মুসলমান বানাতে তাদের ‘মুসলমানি’ করানো হয়। কিন্তু গরুদের ব্যাপারে এমন কোন নিয়ম নেই কেন? খুব ভাল হত যদি নানা-বাড়ির গরুগুলোকেও ‘মুসলমানি’ করানো যেত। তাহলে খুব সহজেই বোঝা যেত কোন গরুর সাথে খাবার সময় কথা বলা যাবে, আর কোনটার সাথে যাবে না।
আমার এক মামা বিদেশে থাকে। তিনি একবার বলছিলেন হালাল গরুর নাকি সেখানে অনেক অভাব। আমি সেদিন বুঝতে পারেনি হালাল গরু কি জিনিষ? মামাকে তখন জিজ্ঞেস করতে মনে ছিল না। এখন পারছি। নিশ্চয়ই মুসলমান গরুকেই হালাল গরু বলে। বাবাকে একদিন জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে হবে।
অবশ্য আমি শুনেছিলাম, ‘মুসলমানি’ হলে নাকি মানুষের লজ্জা বাড়ে। মুসলমানির পর গরুরও লজ্জা বেড়ে গেলে সমস্যা। তখন তাদেরকে প্যান্ট পড়িয়ে রাখতে হবে। সেই প্যান্টের ভেতরে তারা পায়খানা করে দেবে একটু পর-পর। তারা তো অনেক সহজ-সরল, তাই মনে হয় না কমোডে গিয়ে পেসাব-পায়খানা করার ব্যাপারটা তারা ঠিক বুঝতে পারবে। আমার অবশ্য এক খালা আছে। তার বিড়াল কমোডে বসে বাথ্রুম করে। গরুটাকে কিছুদিনের জন্য খালার কাছে পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। সেখান থেকে শিখে আসল কি করে কমোড ব্যাবহার করতে হয়।
এসব চিন্তা করতে করতেই দেখি আমাদের ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করেছে। গরুটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আগের মতই। এখন ও জাবর কাটছে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
ট্রেন একটু দূরে যাবার পর আমি জানলা দিয়ে মাথা বের করে গরুটাকে আবার দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম সেটা আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে গেল!
Search terms: Tukun_er_diary, Eid, Fahim Aziz
Search Term: Bengali short story, fahim aziz, Bangla short story, Tukun_er_diary, Eid